প্রথম বই : দ্য থিভিং ম্যাগপাই
জুন ও জুলাই ১৯৮৪
1
মঙ্গলবারের চাবি-দেয়া পাখি
.
ছয় আঙ্গুল ও চার স্তন
ফোনটা যখন বাজতে শুরু করেছিলো, আমি তখন রান্নাঘরে। স্প্যাগেটি সেদ্ধ করতে করতে রেডিওতে ব্রডকাস্ট করা রসিনি এর ‘থিভিং ম্যাগপাই’ রেকর্ডের তালে তালে শিস বাজাচ্ছিলাম। পাস্তা রান্না করার সময় কেন জানি এই গানটা একদম নিখুঁতভাবে মানিয়ে যায়।
ফোনটা ধরতে মন চাচ্ছিলো না। প্রথমত, স্প্যাগেটি প্রায় সেদ্ধ হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয়ত, রেডিওতে ক্লডিও আব্বাডো* তার লন্ডন সিম্ফোনি’র একদম ক্লাইম্যাক্সে চলে এসেছেন। শেষমেষ ফোনটা ধরার ইচ্ছের কাছে সেগুলো হার মানলো। হয়ত কেউ চাকরির খবর জানানোর জন্য ফোন করেছে। আগুনের আঁচটা কমিয়ে দিয়ে লিভিং রুমে চলে গেলাম। রিসিভারটা তুললাম।
“প্লিজ, দশটা মিনিট সময় দিন,” ফোনের অপর পাশ থেকে একটা মহিলা বলে উঠলো।
সাধারণত মানুষজনের কন্ঠস্বর আমি ভালোভাবেই মনে রাখতে পারি। কিন্তু এ গলাটা আমার চেনাজানা কারোর নয়।
“মাফ করবেন, কার সাথে কথা বলতে চাইছেন?”
“কেন,
তোমার সাথে! দশটা মিনিট সময় দাও। এর মধ্যেই আমাদের মধ্যে চেনাজানা হয়ে যাবে।” সে মৃদুস্বরে কথাগুলো বলছিল। সেটা বাদ দিলে তার মধ্যে আলাদা করে বলার মত কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল না।
“চেনাজানা মানে? কোন ধরণের চেনাজানা?”
“একে অপরের অনুভূতির সাথে চেনাজানা।”
আমি রান্নাঘরের ভেতর উঁকি দিলাম। স্প্যাগেটিটা ভালোভাবেই সেদ্ধ হচ্ছে, ক্লডিও আব্বাডো* এখন মধুর সুরে থিভিং ম্যাগপাই কনডাক্ট করে যাচ্ছেন।
“মাফ করবেন, আমি আসলে এখন স্প্যাগেটি বানাতে ব্যস্ত আছি। একটু পরে ফোন করতে পারবেন?”
“স্প্যাগেটি? এই সকাল সাড়ে দশটার সময় স্প্যাগেটি বানাচ্ছো কেন?”
“সেটা জেনে আপনার কাজ নেই,” আমি জবাব দিলাম। “আমার যখন মন চাইবে, আমি তখন স্প্যাগেটি রান্না করে খেতে পারবো।”
“তা ভুল বলোনি। আচ্ছা, একটু পর ফোন দিচ্ছি,” তার গলার স্বর এখন ভোঁতা ও অনুভূতিহীন হয়ে গিয়েছিল। মানুষের মনের অবস্থা খানিকটা পাল্টে গেলেই তার স্বরের মধ্যেও পরিবর্তন দেখা দেয়।
“একমিনিট,” সে ফোনটা কেটে দেবার আগে আমি বললাম। “এটা যদি জিনিসপত্র বেচাবিক্রি সম্পর্কিত কিছু হয়, তবে আপনি কথা বলার কথা ভুলে যেতে পারেন। আমি এখন বেকার। তাই কিছু কেনাকাটা করার একদম ইচ্ছে নেই।”
“চিন্তা করো না। সেটা আমি জানি।”
“জানেন? কী জানেন?”
“তুমি যে এখন বেকার, সেটা আমার জানা আছে। যাও, তোমার অতিপ্রিয় স্প্যাগেটি রান্না করোগে।”
“আপনি কে…”
সে ফোনটা কেটে দিল।
মনের ভাবটা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হওয়ায় আমি কিছুক্ষণ হাতের রিসিভারটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। স্প্যাগেটির কথা মনে পড়লো। রান্নাঘরে ফিরে চুলার আগুন বন্ধ করে দিলাম। তারপর স্প্যাগেটি একটা ঝাঁঝরির মধ্যে ঢেলে নিলাম। ফোনটার কারণে স্প্যাগেটি খানিকটা নরম হয়ে গিয়েছে। তবে একদম বাজে হয়নি। খাওয়া শুরু করলাম, আর হ্যাঁ, সেই সাথে চিন্তা করাও শুরু করলাম।
একে অপরের সাথে চেনাজানা? দশমিনিটের মধ্যে একে অপরের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করা?
সে কী বলার চেষ্টা করছিলো? হয়ত ওটা প্র্যাংক কল ছিল। কিংবা নতুন কোনো গিমিকের মাধ্যমে বেচাবিক্রি করার ধান্দা। যেটাই হোক,
তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
দুপুরের খাবার শেষে আমি হাতে লাইব্রেরি থেকে আনা উপন্যাসটা নিয়ে লিভিং রুমের সোফায় আরাম করে বসলাম। কেন জানি একটু পর পর টেলিফোনের দিকে আড়চোখে তাকাতে থাকলাম। দশমিনিটের মধ্যে আমরা কীভাবে একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করবো?
ভেবে দেখলাম, সে ঐ ‘দশ মিনিট’ এর ব্যাপারটাতে একদম নিশ্চিত ছিল। ফোনে বলা প্রথম শব্দ জোড়াই ছিল ওটা। যেন নয় মিনিট বললে কম হয়ে যাবে, আবার এগার মিনিট বললে খুব বেশি হয়ে যাবে; অনেকটা সঠিকভাবে দৃঢ় স্প্যাগেটি রান্না করার মত।
বইটা পড়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, শার্ট ইস্ত্রি করবো। মন খারাপ হলে আমি শার্ট ইস্ত্রি করা শুরু করি। এটা আমার অনেক পুরোনো একটা অভ্যাস। গোটা কাজটাকে আমি বারোটা নিখুঁত ভাগে ভাগ করে নিই। শুরু করি কলার থেকে (কলারের বাইরের দিকটা), শেষ করি বাম হাতের আস্তিনে গিয়ে। প্রত্যেকবার এভাবেই ধাপে ধাপে কাজটা সম্পন্ন করি। মনে মনে প্রতিটা ধাপের হিসেব রাখি। একটা করে ধাপ শেষ করে সেটা মনের খাতায় কেটে দিই। তা না হলে কাজতা ভালো ভাবে সম্পন্ন হবে না।
তিনটে শার্ট ইস্ত্রি করলাম। শার্টে কোনো ভাঁজ পড়েছে কিনা দেখে নিয়ে সেটা হ্যাংগারে ঝুলিয়ে রাখলাম। ইস্ত্রিটার সুইচ বন্ধ করে সেটা সরিয়ে রাখলাম। হল ক্লজেটে আয়রনিং বোর্ডটা রেখে দেবার পর বিক্ষিপ্ত মনটা একটু শান্ত হতে শুরু করলো।
এক গ্লাস পানি খাওয়ার জন্য রান্নাঘর যাচ্ছিলাম, এমন সময় ফোনটা আবার বেজে উঠলো। আমি এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধাবোধ করলাম, তারপর সিদ্ধান নিলাম ফোনটা ধরব। যদি ঐ একই মহিলাই ফোন করে থাকে, তবে আমি শার্ট ইস্ত্রি করায় ব্যস্ত আছি বলে ফোনটা কেটে দেব।
এবার কুমিকো ফোন করেছে। দেয়ালঘড়িটায় তখন সাড়ে এগারোটা বাজে। “কেমন আছো?”
সে জিজ্ঞেস করলো।
“ভালো,”
জবাব দিলাম। স্ত্রীর গলার স্বর শুনতে পেরে আগের তুলনায় স্বস্তি লাগছে।
“কী করছো?”
“শার্ট ইস্ত্রি করা শেষ করলাম।”
“কী হয়েছে?” তার গলায় একটু উদ্বেগ টের পেলাম। সে জানে আমি কেন হঠাৎ করে ইস্ত্রি করা শুরু করি।
“কিছু না। এমনি মনে হল,
তাই কয়েকটা শার্ট ইস্ত্রি করলাম।” সোফায় বসে ফোনের রিসিভারটা বাম থেকে ডান হাতে নিলাম। “কিছু বলবে?”
“তুমি কবিতা লিখতে পারো?”
সে জিজ্ঞেস করলো।
“কবিতা!?” কবিতা? সে কি এইমাত্র ‘কবিতার’ কথা বললো?
“আমার সাথে একটা মেয়েদের ম্যাগাজিনের প্রকাশকের বেশ জানাশোনা রয়েছে। পাঠকদের পাঠানো কবিতা যাচাই বাছাই করার জন্য একজন লোক খুঁজছে। আর হ্যাঁ, তাকে প্রতিমাসে প্রচ্ছদপটে একটা ছোট কবিতা লিখতে হবে। কাজটা সোজা হলেও টাকাপয়সা কিন্তু মন্দ নয়। অবশ্য কাজটা পার্ট-টাইম, এই যা। কিন্তু যদি কাজটাতে তারা দক্ষ কোনো লোক পায় তবে সম্পাদকের কাজটাও তারা দিতে রাজি…”
“সোজা কাজ?” আমি তাকে থামালাম। “একমিনিট দাঁড়াও। আমি ল’
এর কাজ খুজছি, কবিতার নয়।”
“আমি যতদূর জানি তুমি হাইস্কুলে থাকতে খানিকটা লেখালেখি করেছিলে।”
“হ্যাঁ, তা ভুল বলোনি। কিন্তু সেটা ছিল স্কুলের পত্রিকার জন্য : কোন ফুটবল টিম খেলায় জিতেছে কিংবা পদার্থবিদ্যার শিক্ষক কীভাবে সিঁড়ি থেকে পড়ে গেলেন- এই টাইপ খবর। কবিতা নয়। আমি কবিতা লিখতে পারি না।”
“তা বুঝেছি। কিন্তু আমি তো অসাধারণ কালজয়ী কোনো কবিতা লিখতে বলছি না। হাইস্কুলের মেয়েদের জন্য কবিতা লেখার কথা বলছি। ওটাকে ইতিহাসে স্থান নেয়া লাগবে না। ওরকম কবিতা তুমি চোখ বন্ধ করেই লিখতে পারবে। কি, ঠিক বলছি না?”
“দেখো,
আমি কবিতা লিখতে পারবো না;
সেটা চোখ খোলা রেখে হোক কিংবা বন্ধ রেখে। আগে কখনো লেখিনি, এখন সেটা শুরু করার প্রশ্নই আসে না।”
“ঠিক আছে,” কুমিকো খানিকটা খেদ নিয়ে কথাটা বললো। “কিন্তু তুমি যেরকম কাজ খুঁজছো, আজকাল তা পাওয়া খুবই দুর্লভ।”
“তা জানি। সেজন্যই চারদিকে লাইনঘাট করে রেখেছি। এই সপ্তাহের মাঝেই কিছু একটা পেয়ে যাবো। যদি না পাই, তবে তখন অন্যকিছু করার কথা ভাববো।”
“আচ্ছা, তুমি যদি বলো তবে তাইই সই। যাকগে, আজকে কী বার?”
একমুহূর্তের মত চিন্তা করে উত্তর দিলাম, “মঙ্গলবার।”
“তাহলে তুমি আজকে ব্যাংকে গিয়ে গ্যাস আর টেলিফোন বিলটা দিয়ে আসতে পারবে?”
“ঠিক আছে। এখন এমনিতেই রাতের খাবারের জন্য কেনাকাটা করতে বের হতাম।”
“আজকের মেন্যু কী?”
“এখনো নিশ্চিত না। কেনাকাটা করার সময় ঠিক করব।”
সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। “একটা কথা,”
সে এবার সিরিয়াস ভাবে বললো,
“তোমার চাকরি পাওয়াটা কিন্তু খুব জরুরী কোনো বিষয় নয়।”
হঠাৎ করে এরকম কথা শোনায় থতমত খেয়ে গেলাম। “হঠাৎ এই কথা?” আজ গোটা পৃথিবীর সকল মহিলা কি আমাকে ফোন করে চমকে দিতে চাইছে? “আমার বেকারত্ব কিছুদিন পরেই দূর হয়ে যাবে। এভাবে ঘরে বসে থাকলে তো আমার চলবে না।”
“তা সত্যি, কিন্তু আমার বেতন বৃদ্ধি পাওয়ায় মাঝেমধ্যে টুকটাক পার্ট-টাইম চাকরি আর জমানো টাকা দিয়ে আমরা অনায়সে সংসার চালাতে পারবো। একটু সতর্ক করে খরচ করতে হবে এই যা। চাকরি পাওয়াটা কিন্তু ততটা জরুরী বিষয় নয়। ঘরে বসে থেকে ঘরের কাজকর্ম করতে তোমার বিরক্ত লাগছে? মানে জিজ্ঞেস করছিলাম, এই ভাবে জীবন কাটালে তোমার সমস্যা হবে?”
“আমি জানি না,” সত্যিটাই বললাম। আসলেই আমি জানি না।
“তাহলে সময় নিয়ে ভেবে দেখো,” সে বলল। “যাকগে, বিড়ালটা ফিরে এসেছে?”
বিড়াল। সারাসকাল ধরে বিড়ালটার কথা ভাবিইনি। “না,” আমি বললাম। “এখনো ফিরে আসেনি।”
“তুমি বাড়ির আশেপাশে একটু খোঁজ করতে পারবে? প্রায় এক সপ্তাহ হল বিড়ালটা ফিরে আসছে না।”
আমি অসম্মতির সুরে ঘোঁত করে একটা শব্দ করে বাম হাতে রিসিভারটা নিলাম। সে বলতে থাকলো :
“আমি নিশ্চিত ওটা গলির শেষমাথার খালি বাড়িটায় গিয়ে আস্তানা গেড়েছে। ঐ যে, যে বাড়িটার উঠোনে একটা পাখির মূর্তি আছে। আমি বেশ কয়েকবার ওটাকে ওখানে দেখেছি।”
“গলি?
কবে থেকে তুমি গলিটাতে যাওয়া শুরু করলে? একবারো তো কিছু বলোনি…”
“এই রে! কাজে ডাক পড়েছে। অনেক কাজ রয়ে গিয়েছে। বিড়ালটার কথা ভুলো না কিন্তু।”
সে ফোনটা কেটে দিল। আবিষ্কার করলাম, আমি এবারেও রিসিভারটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। তারপর রিসিভারটা জায়গামত রেখে দিলাম।
কুমিকো কেন ঐ গলিতে গিয়েছিল তা ভাবলাম। আমাদের বাড়ি থেকে ওখানে যেতে হলে সিমেন্টের দেয়ালটা টপকাতে হবে। কিন্তু দেয়াল টপকিয়েই বা কি লাভ,
ওখানে যাওয়ার পেছনে কোনো কারণ দেখছি না।
রান্নাঘরে ঢুকে একগ্লাস পানি খেলাম। তারপর বারান্দায় গিয়ে বিড়ালের খাবার পাত্রটা পরীক্ষা করলাম। গতরাতে রেখে দেয়া সার্ডিন মাছের স্তুপটা এখনো আগের মতই রয়েছে। কেউ স্পর্শ পর্যন্ত করেনি। ওখানে দাঁড়িয়ে আমি আমাদের ছোট বাগানের দিকে তাকালাম। গ্রীষ্মের পরিচিত সেই সূর্যালোক উদারভাবে আমাদের ছোট্ট বাগানটাকে আলোকিত করে দিচ্ছে। তবে আমাদের বাগানটা অত সুন্দর নয় যে, ওটার দিকে তাকালেই মনটা ভাবুক হয়ে যাবে। সূর্য নানান ফাঁকফোকর দিয়ে আমাদের বাগানটাতে অল্প সময়ের জন্য ঢুকে পড়ে। তাই বাগানটার মাটি সবসময়েই আর্দ্র থাকে। আর বাগানটার এক কোণে কেবল কয়েকটা হাইড্রেঞ্জিয়া ফুলগাছ লাগানো হয়েছিল। অথচ আমি এই হাইড্রেঞ্জিয়া ফুলটা তেমন একটা পছন্দ করি না। বাগানের কাছেই কয়েকটা গাছগাছালি ছিল। সেখান থেকে একটা পাখির ডাক শোনা যায়। পাখিটার ডাক শুনলে মনে হবে একটা স্প্রিং দেয়া যান্ত্রিক পাখি ওটা। আমরা সেটাকে ‘চাবি-দেয়া পাখি’
বলেই ডাকতাম। কুমিকোই নামটা দিয়েছিল। আসলে যে ওটার কী নাম কিংবা ওটা দেখতে কীরকম- তার কিছুই আমাদের জানা ছিল না। কিন্তু তাতে ওটার যায় আসে না। প্রত্যেকদিন সকালে সে আমাদের গাছগাছালিতে এসে বসে আমাদের শান্ত, নিঃস্তব্ধ জগতটার চাবি ঘুরিয়ে সেটাকে চালু করে দেয়।
এখন তাহলে আমাকে বিড়াল খুঁজতে বের হতে হবে। আমি সবসময়ই বিড়াল ভালোবেসে এসেছি। বিশেষ করে আমাদের বিড়ালটার অনেক ভক্ত ছিলাম আমি। কিন্তু বিড়ালদের জীবনযাপনের নিজস্ব একটা রীতি আছে। তারা বোকা কোনো প্রাণি নয়। যদি কোনো বিড়াল তোমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে চলে যায় তবে ধরে নেবে,
সেটা অন্য কোথাও যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদি ওটা ক্লান্ত কিংবা ক্ষুধার্ত হয়,
তবে সে ফিরে আসবে। তবুও কুমিকো’কে খুশি রাখার জন্য আমি বিড়ালটার খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। আসলে করার মত কিছুই আমার হাতে নেই।
*
এপ্রিলের শুরুতে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম- গ্রাজুয়েশনের পর যে ল’ ফার্মটাতে চাকরি পেয়েছিলাম, সেটা। না, চাকরি ছাড়ার পেছনে কোনো বিশেষ কারণ ছিল না। যে কাজটা আমাকে করতে হত, সেটা আমি অপছন্দ করতাম না। খুব উত্তেজনাকর কাজ নয়,
তবে মাসশেষে ভালই বেতন পেতাম। তাছাড়া অফিসের পরিবেশটা অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল।
ফার্মটাতে আমাকে যে কাজটা করতে হত,
সেটাকে সহজ ভাষায় ‘পিয়নের কাজ’
বলা যায়। কাজটায় আমি কিন্তু ভালই পারদর্শী ছিলাম। এরকম কাজে আমি যে দক্ষ ছিলাম তা বললেও কিন্তু ভুল হবে না। আমি চটপটে, দক্ষ, কখনো কাজটা নিয়ে অভিযোগ করিনি। আর হ্যাঁ, আমি ছিলাম বাস্তববাদী একজন মানুষ। তাই আমি যখন আমার ফার্মের সিনিয়র পার্টনারের কাছে
(ল’ ফার্মটা দুজন পিতা-পুত্র মিলে চালাতো, সিনিয়র পার্টনারটা ছিল পিতা) গিয়ে বললাম যে, আমি চাকরি ছেড়ে দিতে চাই,
তিনি আমাকে চাকরি না ছাড়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। এমনকি তিনি বেতনটা সামান্য বাড়িয়ে দিতেও রাজি ছিলেন।
কিন্তু তারপরেও চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। তারমানে এই না যে, চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে আমি নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য কিংবা স্বপ্নের পেছনে ছোটা শুরু করবো। তবে ঘরে নিজেকে বন্ধ করে রেখে বার পরীক্ষার জন্য পড়াশোনার কথা কল্পনাতেও আসেনি। আমি একদম নিশ্চিত ছিলাম যে, আমি উকিল হতে চাই না। সেই সাথে আরেকটা ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত ছিলাম- আমি যে চাকরিটা করছি, সেখানে আমি আর থাকতে রাজি নই। যদি চাকরিটা ছাড়তেই হয়, তবে এখনই সেটার উপযুক্ত সময়। যদি আরো বেশ কিছুদিন চাকরিটার সাথে যুক্ত থাকি,
তবে জীবনেও চাকরিটা ছাড়তে পারবো না। বয়স যে তিরিশের কোঠায় চলে গিয়েছে।
ডিনার টেবিলে বসে আমি আমার সিদ্ধান্তটা কুমিকো’কে জানিয়েছিলাম। সে খুবই নিরাসক্ত গলায় সংক্ষিপ্ত ভাবে উত্তর দিয়েছিল, “তাই নাকি।” সে মনে মনে কী ভাবছে, তা আমি বুঝতে পারিনি। বেশ কিছুক্ষণ সে চুপচাপ ছিল।
আমি নিজেও চুপচাপ ছিলাম, কিন্তু সে আবার কথা বলা শুরু করেছিলো, ‘যদি তুমি চাকরিটা ছাড়তে চাও, ছেড়ে দিতে পারো। এটা তোমার জীবন, তুমি যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে জীবনটা উপভোগ করতে পারো।” একটানা কথাগুলো বলার পর সে চপস্টিক দিয়ে মাছের কাঁটা বেঁছে সেগুলো প্লেটের কোণায় রাখা শুরু করলো।
কুমিকো একটা হেলথ ফুড ম্যাগাজিনে সম্পাদকের কাজ করে ভালো আয় করতো। মাঝেমধ্যে অন্যান্য ম্যাগাজিন কিংবা সম্পাদক বন্ধুদের জন্য ইলাস্ট্রেশনের কাজ করেও তার বেশ উপরি আয়ও হত( কলেজে থাকতেই সে ডিজাইনের কাজ শিখেছিল। তখন নাকি সে একজন ফ্রিল্যান্স ইলাস্ট্রেটর হবার স্বপ্ন দেখত)। তাছাড়া চাকরিটা ছেড়ে দিলে বেকার ভাতা দিয়ে আমার বেশ কিছুদিন স্বাচ্ছন্দে চলে যাবে। এর মানে আমি যদি ঘরে থেকে ঘরের কাজকর্ম করি,
তারপরেও আমাদের বাইরের খাওয়াদাওয়া, ক্লিনিং বিল দেয়ার মত অতিরিক্ত চাহিদা পূরণ করার মত টাকা রয়ে যাবে। মোদ্দা কথা,
আমাদের জীবনযাত্রার ধরণ খুব একটা পাল্টাবে না।
এসব ভেবেই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
ফ্রিজে শাকসবজি কেমন আছে তা দেখছিলাম, এমন সময় ফোনটা তৃতীয়বারের মত বেজে উঠল। এবারের ফোনের রিং এর মধ্যে কেমন একটা অস্থিরতা টের পাচ্ছিলাম। আমার হাতে তখন একটা টোফু ভর্তি প্লাস্টিকের প্যাকেট। সেটা খুলে ফেলেছিলাম বিধায় পানিভর্তি প্যাকেটটা সাবধানে টেবিলে রেখে দিলাম। লিভিং রুমে গিয়ে ফোনটা ধরলাম।
“এতক্ষণে তোমার স্প্যাগেটি খাওয়া শেষ হবার কথা,”
মহিলাটা বললো।
“তা ঠিক ধরেছেন। কিন্তু এখন আমাকে আমাদের বিড়ালটা খুঁজতে বের হতে হবে।”
“সেটার জন্য দশ মিনিট পরে বের হলেও সমস্যা হবে না। এটা তো আর স্প্যাগেটি রান্নার মত কাজ নয়।”
কেন জানি ফোনটা কেটে দিতে মন চাইলো না। মহিলার গলার স্বরে কী যেন একটা ছিল যেটা আমার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল। “আচ্ছা, ঠিক আছে। তবে আমি দশমিনিটের বেশি সময় দিতে পারব না।”
“যাক,
এতক্ষণে আমরা একে অপরকে বোঝা শুরু করতে পারবো,” সে বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো। টের পেলাম, সে ফোন হাতে আরাম করে একটা চেয়ারে হাঁটুভাঁজ করে বসলো।
“তা বলতে পারছি না,”
আমি বললাম। “মাত্র দশ মিনিটে কিই বা করা যায়?”
“দশ মিনিট কিন্তু মাত্র নয়। ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে।”
“আপনি কি নিশ্চিত যে আপনি আমাকে চেনেন?”
“অবশ্যই। কয়েকশতবারের মত আমাদের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে।”
“কোথায়? কখন?”
“কোনো এক জায়গায়, কোনো এক সময়ে,”
সে উত্তর দিলো। “কিন্তু সেটা নিয়ে কথা বলা শুরু করলে দশ মিনিটে সবকিছু শেষ করা যাবে না। বরং এখন যে সময়টা রয়েছে, সেটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘বর্তমান সময়’। ঠিক বলছি না?”
“হয়ত বলছেন। কিন্তু আমি প্রমাণ চাই যে, আপনি আমাকে আসলেই চেনেন।”
“কী ধরণের প্রমাণ?”
“আমার বয়সের ব্যাপারেই না হয় কিছু বলুন।’
“তিরিশ,” সে ঝট করে উত্তর দিলো। “তিরিশ বছর দু’মাস। ঠিক আছে?”
আমি চুপ হয়ে গেলাম। সে আসলেই আমাকে চেনে। কিন্তু তার গলার স্বরের কোনো স্মৃতি আমার মনে পড়ছে না।
“এবার তোমার পালা,” সে আবেদনময়ী কন্ঠে বলা শুরু করলো। “। আমার গলার আওয়াজ থেকে আমাকে কল্পনা করার চেষ্টা করো। আমি কীরকম দেখতে, আমার বয়স কত, আমি এখন কোথায়, কী জামা পরে আছি। করো, কল্পনা করো।”
“কোনো ধারণা করতে পারছি না,” আমি জবাব দিলাম।
“আহ হা, চেষ্টা তো করো,” সে বললো।
আমি আমার হাতঘড়িটার দিকে তাকালাম। এতক্ষণে কেবল একমিনিট পাঁচ সেকেন্ড পার হয়েছে।