২.
মাশিবা দম্পত্তি যখন
সিঁড়ি বেয়ে নামছিল, তখন তাদের দেখেই কেমন একটা সন্দেহ হল হিরোমি ওয়াকাইয়ামা এর । তাদের
হাসি হাসি মুখ , বিশেষ করে আয়ানে এর হাসি মুখটা যে জোর করে করা, তা বোঝাই যাচ্ছে ।
“ এতক্ষন অপেক্ষা
করানোর জন্য দুঃখিত । ” ইয়োশিতাকা সিঁড়ি থেকে
নেমেই বলল । “ তুমি কি ইউকিকো দম্পত্তিদের কাছ থেকে কিছু শুনেছ ? ”
“ ইউকিকো একটা মেসেজ
রেখে গিয়েছে যে, তারা পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এসে পড়বে এখানে । ” হিরোমি তাকে জানালো ।
“ তাহলে ত আমাকে এক্ষুনি
শ্যাম্পেন টা জোগাড় করে রাখতে হয় ! ”
“ আমিই করছি সেটা
। ”
আয়ানে হড়বড় করে বলে উঠল আচমকা । “ হিরোমি , তুমি গ্লাসগুলো আনতে পারবে
? ”
“ অবশ্যই । ”
“ তাহলে আমি টেবিলটা ঠিক করছি ”, ইয়োশিতাকা জানালো ।
দেখতে না দেখতেই আয়ানে
দ্রুত কিচেনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো , তা আবার হিরোমি ডাইনিং রুমে পৌঁছানোর আগেই । ডাইনিং
রুমের দেয়ালের কাপবোর্ড তার উদ্দেশ্য । কাপবোর্ডটা
অ্যান্টিক/ এন্টিক ছিল , দাম প্রায় তিন মিলিয়ন ইয়েনের আশেপাশে । কাপবোর্ডের ভেতরের
গ্লাসগুলোও সেরকম দামী ছিল ।
খুব সাবধানে সে কাপবোর্ড
থেকে পাঁচটা শ্যাম্পেন গ্লাস বের করল – দুটো ‘ব্যাকারাট’* আর তিনটে ‘ভেনেশিয়ান’* স্টাইলের গ্লাস । মাশিবা দম্পত্তিদের সংসারে অতিথিদের ভেনেশিয়ান ন্সটাইলের গ্লাসে শ্যাম্পেন খাওয়ানোই
রীতি ।
ইয়োশিতাকা তখন আটজনের
ডাইনিং টেবিলকে পাঁচজনের বসার জন্য সাজাচ্ছে । সে এসব কাজে বেশ পটু, আর হিরোমি তার
কাজ দেখতে দেখতেই শিখে ফেলেছে কাজগুলো ।
হিরোমি আস্তে আস্তে
শ্যাম্পেন গ্লাসগুলো তার জায়গামত রাখছিলো । রান্নাঘর থেকে পানি পড়ার শব্দ ভেসে এল ।
কাজ করতে করতে সে ইয়শিতাকার কাছাকাছি এসে পড়ল ।
“ আপনি কি উনাকে কিছু
বলেছেন ? ” ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল হিরোমি
।
“ না, তেমন কিছুই
ত বলিনি । ” মাথা না তুলেই ব্যস্ত অবস্থাতেই
উত্তর দিল ইয়োশিতাকা ।
“ মানে... কথা ত হয়েছে
? ”
এবার তার দিকে তাকালো
ইয়োশিতাকা , “ কী নিয়ে ? ”
‘সে যখনই বলতে যাবে ‘কী নিয়ে ?!?!’ , তক্ষুনি কলিং বেলটা বেজে উঠল ।
ইয়োশিতাকা কিচেনের
উদ্যেশ্যে একটু উঁচু গলায় বলে উঠল , “ ওরা এসে গেছে । ”
“ দুঃখিত , আমার হাতটা
কাজে ব্যস্ত । তুমি একটু দরজাটা খুলে দিবে ? ” আয়ানের গলা ভেসে এলো রান্নাঘর থেকে ।
“ অবশ্যই ” , ইয়োশিতাকা
উত্তর দিল । দেয়ালে লাগানো ইন্টারকম টা তুলে নিলো সে ।
দশ মিনিট পর ।
মাশিবা দম্পত্তি আর
তাদের অতিথিরা ডাইনিং টেবিলে বসে আড্ডা দিচ্ছিল । সকলেরই হাসিমুখ ছিল ; কিন্তু হিরোমির
কাছে মনে হল সকলের হাসিই মেকি মেকি – যেন ক্যাজুয়াল পরিবেশটা বজায় রাখতে সবাই দৃঢ়ভাবে
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ । কত কষ্ট করেই না এ ব্যাপারগুলো শিখতে হয় , হিরোমি মনে মনে ভাবল
। জন্ম থেকে ত আর এসব শিখে আসা যায়না । আয়ানের যে প্রায় একবছরের মত লেগেছে এসব শিখতে,
তা হিরোমির অজানা ছিলনা ।
“ বরাবরের মতই আপনার
রান্না চমৎকার হয়েছে , আয়ানে ! ” মুখভর্তি
মাছ নিয়ে চাবাতে চাবাতে প্রশংসা করল ইউকিকো ইকাই । “ মাছের ম্যারিনেট করা যে এতটা শৈল্পিকভাবে
করা সম্ভব , তা অনেকেই জানেনা । ” ডাইনিং টেবিলে
ইউকিকোর ভূমিকাই ছিল প্রত্যেকটা খাবারের প্রশংসা করা ।
“ তুমি ত মুগ্ধ হবেই ” পাশে থেকে তার স্বামী বলে উঠল । “ অথচ নিজে ত সবসময় ঠিকই ইন্সট্যান্ট সস কিনে ব্যবহার
কর ! ”
“ মাঝেমধ্যে কিন্তু
আমিও বানাই সস । ”
“ বোধহয় ঐ আওজিসো
সস* গুলো । ঐ যে পুদিনার সসের মত । ”
“ তাতে কী হ্যা
!? ওটাও ত স্বাদ লাগে খেতে । ”
“ আমারো কিন্তু আওজিসো
সস পছন্দ ” , আয়ানে যোগ দিলো তাদের কথাবার্তায়
।
“ দেখেছ ? তাছাড়া যেটা আমি বানাই, ওটা স্বাস্থ্যকরও বটে । ”
“ প্লিয আয়ানে, ওকে
আর তাল দিবেন না । ” মুখ গোমড়া করে তাতসুহিকো
( ইউকিকোর স্বামী ) বলল । “ পরে দেখা যাবে , আমার স্টেক এর টুকরাতেও সে ওসব যা-তা সস
ঢালছে ! ”
“ শুনেই ত আমার আগ্রহ
বেড়ে গেল । ” ইউকিকো উত্তেজিত গলায় বলল , “
পরবর্তীতে তাহলে এটাই বানাচ্ছি তোমার জন্য !
”
তাতসুহিকো বাদে ডাইনিং
টেবিলের সবাই হেসে উঠল ।
তাতসুহিকো পেশায় একজন
উকিল । অনেক কোম্পানি বা ব্যবসাতেই সে আইনগত পরামর্শ দিয়ে থাকে, এমনকি মাশিবা দের ও
। সে মাশিবা'দের কোম্পানির ম্যানেজমেন্টে ভালোবাসেই জায়গা করে নিয়েছে । সে আর ইয়োশিতাকা
দুজনেই কলেজ থেকে বন্ধু ।
তাতসুহিকো ফিজ থেকে
একবোতল ওয়াইন বের করে হিরোমিকে জিজ্ঞেস করল , তার গ্লাসে কিছুটা ঢেলে দিবে কিনা ।
গ্লাসের ওপর হাত রেখে
হিরোমি মানা করলো ,“ না না ঠিক আছে, আমার আর লাগবেনা । ধন্যবাদ আপনাকে । ”
“ তাই ? আমি ত জানতাম
তোমার সাদা ওয়াইন পছন্দ । ”
“ হ্যাঁ , পছন্দ করি
, কিন্তু বেশি খাওয়া হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই । আবারো ধন্যবাদ আপনাকে । ”
তাতসুহিকো একটু নিরাশ
হলো ব্যাপারটাতে । সে ইয়োশিতাকার গ্লাসে ঢেলে দিল ওয়াইন ।
“ তোমার কি শরীর খারাপ
না ত আবার ? ” আয়ানে উদ্বিগ্ন ভাবে জিজ্ঞেস
করল হিরোমি’কে ।
“ না না আমি সুস্থ
আছি । আসলে হয়েছে কি , কদিন ধরে বাইরে বেশ পান করা হয়ে যাচ্ছে , তাই আপাতত নিজেকে নিয়ন্ত্রনে
রাখছি । ”
“ আহ ! যদি আবার তোমার
বয়সে ফিরে যেতে পারতাম , তাহলে চুটিয়ে পার্টি করতাম !
”
তাতসুহিকো আয়ানের
গ্লাসটা পরিপূর্ন করে দিয়ে আড়চোখে তার স্ত্রীর দিকে তাকালো । এবার বোতলটা দিয়ে নিজের
গ্লাসে ঢালতে ঢালতে বলল , “ ইউকিকো কদিন ধরে এলকোহল পান করা বন্ধ রেখেছে, তাই আমিই
একলা বসে বসে ড্রিংক করি আজকাল । ”
ইয়োশিতাকা নিজের হাতের
চামচটা তুলে তার দিকে ধরে বলল , “ ঠিকই বলেছ । ওর ত এখন এসব বন্ধ করাটাই উচিত , তাইনা
? ”
“ যদি সে দুইজনের
পরিমানে খাওয়া শুরু করে, তবেই সেরেছে । ” তাতসুহিকো হাতের গ্লাসের ওয়াইনটা নাড়াতে নাড়াতে
বলল । “ কারন সে যাবে , সবই তার বুকের দুধে গিয়ে হাজির হবে ! ”
“ কদিন পরে তুমি আবার
এলকোহল পান করতে পারবে ? ” ইয়োশিতাকা তাকে
জিজ্ঞেস করল ।
“ ডাক্তার বলল , প্রায়
একবছর অপেক্ষা করতে হবে । ”
“ উহু , ডাক্তার বলেছে
প্রায় দেড় বছর অপেক্ষা করতে । ” তার স্বামী
জানালো । “ দুইবছর করলেও ক্ষতি নেই । আর যদি এতটা অপেক্ষা করতেই হয় , তবে সেটা একেবারে ছেড়ে দেয়াই যুক্তিযুক্ত । ”
“ ওহ ! তাহলে আমি
বাচ্চার খেয়াল রাখবো , আর একই সাথে পান করাও ছেড়ে দিবো ? কোনোভাবেই সম্ভব না । অবশ্য
তুমি যদি আমাদের সোনামনি রাজপুত্রটার খেয়াল রাখতে রাজি হও , তবে সেটা ভেবে দেখা যেতে
পারে । ”
“ আচ্ছা বাপু , ঠিক
আছে । ” তার স্বামী পরাজিত হবার ভঙ্গী করল
। “ কিন্তু কমপক্ষে একবছর অপেক্ষা করবে , আর পরে শুরু করলে সামলে চলবে পরিমানটা , ঠিক
আছে ? ”
ইউকিকো তার দিকে কিছুটা
কপট চোখে তাকিয়ে পরক্ষনেই হেসে ফেলল । তার ভাবভঙ্গীতে বোঝা গেল ,এসব নাটকীয়তা তার খুব
পছন্দ ।
দুমাস আগেই ইউকিকো
এর বাচ্চা হয়েছে । তাদের সংসারের প্রথম বাচ্চা সেটা , যার জন্য তাদের অনেক বেশি অপেক্ষা
করতে হয়েছে । তাতসুহিকোর বয়স ৪২ , আর ইউকিকোর ৩৫ । তারা তাদের প্রেগনেন্সীটাকে ব্যাখা দিয়েছিল সর্বশেষ ওভারে ছক্কা পেটানোর মত !
*
“ আজকে তাহলে তোমাদের
বাবু কোথায় ? তোমাদের মা বাবা খেয়াল রাখছেন নাকি তার ? ” ইয়োশিতাকা জিজ্ঞেস করল ।
“ হ্যাঁ ” , তাতসুহিকো মাথা নাড়ল । “ তারা আমাদের বলে দিয়েছে
, যতক্ষন চাই ততক্ষন বাইরে থাকতে পারব । তারা নাকি বাচ্চাটার খেয়াল রাখতে অনেকদিন ধরে
অপেক্ষা করছে ! আসলেই, বাসার কাছে বাবা-মা থাকলে অনেক সময়ই এসব সুবিধা পাওয়া যায় । ”।
“ তবে, সত্যি বলতে
কী , আমি মাঝেমধ্যে সেটা নিয়ে চিন্তা করি ।
” ইউকিকো স্বীকার করল । “ তোমার মা বাচ্চাটাকে খুব বেশি আদর করে একেবারে আহ্লাদি
বানিয়ে ফেলছে । আমার এক বান্ধবী বলেছে , বাচ্চাদের আথে সাথে কোলে না নিয়ে কিছুক্ষন
পর নিতে । ”
ইউকিকোর হাতের গ্লাসটা
খালি দেখে হিরোমি উঠে পড়লো সিট থেকে , “ আমি আপনাকে পানি এনে দিচ্ছি । ”
“ফ্রিজে একবোতল মিনারেল
পানি আছে , পুরো বোতলটাই নিয়ে এসো । ” আয়ানে
তাকে বলে দিলো ।
হিরোমি রান্নাঘরে
গিয়ে ফ্রিজটা খুলল । বিশাল আকারের ফ্রিজ, সেটা আবার মাঝখান দিয়ে খোলা যায় ( মানে দুইদিকে
দুটো দরজা , বামে ও ডানে ) * একপাশের দরজায় মিনারেল পানির বোতল দিয়ে ভরা । সেখান
থেকে একটা তুলে নিয়ে হিরোমি ডাইনিং টেবিলে ফিরে এলো । তার চোখ যখন আয়ানের উপর পড়লো
, আয়ানে ঠোঁটটা আলতো নাড়িয়ে তাকে ধন্যবাদ জানালো ।
ইয়োশিতাকা ঐদিকে বলেই
চলেছে, “ বাচ্চাকাচ্চা নিশ্চয়ই জীবনটা পুরোপুরি পালটে দেয় , তাইনা ? ”
“ তা ত বটেই । তখন
বাচ্চাকে ঘিরেই জীবনটা এগোতে থাকে । ” তাতসুহিকো
উত্তর দিলো ।
“ সেটা আগেই বুঝেছি
। কিন্তু এই যে , হঠাৎ সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল, সেটা কি তোমার কাজে কোনো ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে
? শুনেছিলাম , বাচ্চাকাচ্চা হলে নাকি দায়িত্ব বেড়ে যায় । তোমার কি মতামত এ ব্যাপারে
? তোমার কি মনে হয় তোমাকে আরো বেশি খাটতে হচ্ছে
‘বাবা’ হবার পর ? ”
“ সত্যি বলতে কি,
হ্যাঁ সেটা হচ্ছে । ”
আয়ানে ওদিকে সবার
গ্লাসে গ্লাসে পানি ঢেলে দিচ্ছে , মুখে তখনো তার সেই মেকি হাসিটা লেগে আছে ।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ
তাতসুহিকো বলে উঠল , “ প্রসংগ যখন উঠল, তখন একটা কথা বলেই ফেলি । তোমাদের বিয়ের কদ্দিন
হলো , এক বছরের বেশি নিশ্চয়ই ? তা এখনো তোমাদের দেখে মনে হয় , সদ্য বিয়ে করেছ তোমরা
! এরকম ভাব আর কতদিন থাকবে হ্যাঁ ? ”
“ অ্যাই ! ” ইউকিকো
তার স্বামীর হাতে চাটি মেরে বললো, “ কী সব যা তা বলছো ! ওটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবেনা
। ওটা ওদের ব্যাপার । ”
“ আচ্ছা আচ্ছা। ” জোর করে হেসে তাতসুহিকো সামাল দিল তার স্ত্রীকে
। “ সবার জীবন সবার কাছে । ” বাকি ওয়াইনটা
সে গিলে ফেলল । এরপর হিরোমির দিকে তাকিয়ে বলল, “ যাও কথা দিলাম , এরকম আর উদ্ভট কথাবার্তা
বলবো না । সে প্রসঙ্গ বাদ । তা তোমার স্কুলের কী অবস্থা ? সবকিছু ভালোভাবে চলছে
? ”
“ এখন পর্যন্ত সবই
ঠিকঠাক চলছে । তবে প্রতিদিনই নতুন নতুন জিনিস শিখছি । ”
“ তাই স্বভাবিক ,
তুমি ভালো একটা শিক্ষক পেয়েছো ! ” ইউকিকো বলে
উঠল । এরপর আয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো , “ তাহলে সবকিছু কি আজকাল হিরোমির উপরেই ছেড়ে
দিচ্ছ ? ”
আয়ানে মাথা নাড়লো
, “ ওকে আর শেখানোর কিছু বাকি নেই আমার ।
”
“ বাহ ! চমৎকার
! ” ইউকিকো হিরোমির দিকে মুগ্ধভাবে তাকিয়ে
বললো ।
* ডাবল সাইড ফ্রিজ -- এটা অনেকেই চিনবেন , তাও সুবিধার জন্য দিচ্ছি --
No comments:
Post a Comment