Saturday 13 April 2019

Portraits of his children-1



অক্টোবরের এক ভর সন্ধ্যায় , হাঁটতে বের হবার সময় রিচার্ড ক্যান্টলিং তার দরজার গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা প্যাকেজটা দেখতে পেলেন প্যাকেজটা ওভাবে দেখে তিনি বেশ বিরক্ত হলেন , কারন তিনি তাদের পোস্টম্যানকে বারবার বলে দিয়েছেন , বড়সড় কোনো প্যাকেজ দিতে হলে অন্তত তাদের কলিংবেল টা বাজিয়ে সেটা যেন দিয়ে যায় সেটা না করে বরাবরের মতই সে শুধুমাত্র দরজায় ঠেস দিয়ে রেখে যাচ্ছে এমন খোলা জায়গায় , যে কেউ সেটা তুলে নিয়ে সটকে পড়তে পারে তবে সত্যি বলতে কী, ক্যান্টলিং এর বাসা আশেপাশের বাসা থেকে বেশ দূরে ; একেবারে গলির শেষে নদীর পাশের উঁচুজায়গায় , তাও আবার আশেপাশের বিশাল গাছগুলোর কারনে বাড়িটা একেবারেই লোকচক্ষুর অন্তরালে। তা সত্বেও প্যাকেজটা আচমকা বরফ কিংবা বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হতেই পারত !  


ক্যান্টলিং এর মনের বিরক্ত ভাব কিছুক্ষন পরেই উবে গেল প্যাকেজটা ভারি বাদামী কাগজ দিয়ে মোড়ানো আর টেপ দিয়ে একেবারে আঁটসাট করে বাধা—দেখেই বোঝা যায় কি আছে ভেতরে ভেতরে নিশ্চিতভাবেই একটা পেইন্টিং আছে আর সবুজ মার্কার দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে হাতে লেখা ঠিকানা – এটা নিশ্চিতভাবে মিশেল পাঠিয়েছে তারমানে আরেকটা আত্মপ্রতিকৃতি অনুশোচনাবোধ থেকেই পাঠিয়েছে এটা


সত্যি বলতে কী, ক্যান্টলিং খুবই অবাক হয়েছে , যদিও সেটা তার মুখে প্রকাশ পাচ্ছেনা সে সবসময় একগুঁয়ে স্বভাবেরই ছিল , কারো প্রতি ক্ষোভ সে বছরের পর বছর , এমনকি যুগের পর যুগ ধরে রাখতে পারতো্‌ নিজের ভুল স্বীকার করার প্রবণতা তার মধ্যে কখনোই ছিলনা আর মিশেল, তার একমাত্র সন্তান হওয়ায় তার গুণগুলোই পেয়েছে তার থেকে এরকম উপহার...... ব্যাপারটা কেমন জানি মধুর !

ক্যান্টলিং তার হাঁটার লাঠিটা ঘরের ভেতর রেখে প্যাকেজটা মাটি থেকে তুলে নিলেন বাইরের তীব্র আর্দ্র আর কনকনে ঠান্ডায় সেটা খোলা ঠিক হবেনা, মনে মনে ভাবলেন তিনি প্যাকেজটা ৩ ফুট লম্বা , আর অস্বাভাবিকভাবে ভারি জিনিসটা তিনি আনাড়িভাবে আলগিয়ে ধরে, পা দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে সেটাকে তার স্টাডিরুমে নিয়ে গেলেন রুমটাতে সব পর্দা নামানো, ধূলোয় ভরা আর কেমন যেন একটা গুমোট ভাব।




দু'মাস আগের সেই রাতের পর থেকে স্টাডিরুমটা ব্যবহারই করছেন না তিনি, যে রাতে মিশেল ঝড়ের বেগে হনহন করে বেরিয়ে গিয়েছিল ম্যান্টলের ওপর তার আত্মপ্রতিকৃতিটা এখনো বসে আছে ম্যান্টলের ঠিক নিচের ফায়ারপ্লেসটাকে একটু ঝাড়ামোছা করা দরকার, বুকশেলফগুলোর উপন্যাসগুলো, দামী কালো চামড়ায় মোড়ানো বইগুলোতে এলেমেলো হয়ে আছে, একই সাথে ধুলোর একেবারে আস্তরন পড়ে গিয়েছে৷ ছবিটার দিকে তাকিয়ে ক্যান্টলিং এর মনে একঝটকা রাগ ফিরে এল, পরক্ষনেই বিষন্নতায় ডুবে গেলেন তিনি কাজটা মিশেল ঠিক করেনি ছবিটা আসলেই অনেক সুন্দর ছিল অনেক, তার এরকম ধরনের ছবিই পছন্দ কিন্তু মিশেল এসব বাদ দিয়ে কি সব জঘন্য বিমূর্ত ছবি আঁকত শখের বশে, আর গতানুগতিক পেপারব্যাক বইগুলোর প্রচ্ছদ আঁকত, যা মোটেই ক্যান্টলিং পছন্দ করত না আত্মপ্রতিকৃতিটা মিশেল এর বয়স যখন ২০, তখন সে ক্যান্টলিং কে তার জন্মদিনে উপহার হিসেবে দিয়েছিল ছবিটা এমনভাবে মিশেলকে উপস্থাপন করেছে, যা কোনো ফটোগ্রাফের পক্ষে করা সম্ভব নয় শুধু মুখের রেখাগুলো, তার ধারালো মুখ, নীল চোখ, আর এলেমেলো হয়ে থাকা হালকা ছাইরঙ্গের স্বর্নকেশটাই শুধু ফুটিয়ে তোলেনি , বরং ভেতরের লুকিয়ে থাকা ব্যক্তিত্বটাও ফুটে উঠেছে ওতে তাকে খুব কমবয়েসী,ঝকঝকে চেহারার আর দ্বিধাহীন দেখাচ্ছিল হাসিটা দেখে তার হেলেনের কথা মনে পড়ে গেল , হেলেনও ঠিক এভাবে হেসেছিলো তাদের বিয়ের দিনে মিশেলকে সে একাধিকবার বলেছিলো, তার হাসিটা খুব ভাল লাগে তার


আর সেজন্যই চলে যাবার আগে সেই ছবিটার ওপরেই আক্রমন করে গিয়েছে সে , সবার আগে সেই হাসিটা কে কাটাকুটি করে রেখে গিয়েছে ক্যান্টলিং এর সংগ্রহে থাকা একটা এন্টিক ছুরি দিয়ে , পরে ছবিটার মধ্যে থাকা মুখটা চারটি কোপে একেবারে দফারফা করে দিয়েছে এরপরে চোখগুলো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলে ফেলেছে , যেন আত্মপ্রতিকৃতিটাকে অন্ধ করা ছিল তার উদ্দেশ্য যতক্ষনে তিনি তাকে থামাতে এলেন , ততক্ষনে সে ক্যানভাসটা কেটে ফালিফালি করছিল সেই মুহুর্তটা ক্যান্টলিং কখনোই ভুলবেন না এত কুৎসিত লাগছিল তখন ছবিটাকে দেখতে আর নিজের কষ্টে আঁকা কোনো ছবিকে যে এভাবে ধ্বংস করতে পারে কেউ, সেটা তার কল্পনাতেই ছিলনা তিনি নিজেকে কল্পনা করলেন , তিনি তার প্রিয় উপন্যাসগুলোর একটা এভাবে নষ্ট করছেন , বোঝার চেষ্টা করলেন মানসিকভাবে কিরকম আঘাত পেলে মানুষ এরকম আচরন করত্তে পারে, কিন্তু সেটা বুঝতে তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ ছিলেন এরকম ঘটনা যে ঘটানো সম্ভব, সেটা তার কল্পনার বাইরে ছিল

এতকিছুর পরেও বিকৃত সেই ছবিটা সেখানেই ঝুলছিল । রাগ করে সেটা আর নামাননি , কিন্তু সেটার দিকে তাকাতেও সাহস হয়না তার । তাই স্টাডিতেই আসা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি । পুরোনো বাড়িটা , যেটাতে তিনি থাকতেন ছিল বিশাল আকারের, আর তিনি একলা থাকায় তার প্রয়োজনের চেয়েও বেশি রুম খালি পড়ে ছিল । এক শতাব্দী আগে, যখন পেররো শহর কেবল একটা নদীনির্ভর ছোট্ট একটা শহর ছিল , তখন বাড়িটি বানানো হয়েছিল । বাড়িটার গথিক নির্মানকৌশলের মধ্যেই পুরোনো সেই সোনালি দিনগুলো ফুটে ওঠে । তার জানালা দিয়ে আর রেলিং ঘেরা ছাদ থেকে মিসিসিপি নদী বেশ স্পষ্টভাবেই উপভোগ করা যায় । সেই ঘটনার পর থেকে ক্যান্টলিং তার ডেস্ক আর টাইপ রাইটার অন্য একটা অব্যবহৃত ঘরে সরিয়ে রেখেছেন , যাতে স্টাডিরুম টা ব্যবহার না করতে হয় । সেদিন মিশেল যেভাবে রেখে গিয়েছিল ঘরটা, তার এক বিন্দু পরিবর্তন করেননি তিনি । আর যতদিন না মিশেল এসে ক্ষমা চাবে তার কাছে, ততদিন তাই রাখার ইচ্ছে তার ।


এত তাড়াতাড়ি যে ক্ষমা প্রার্থনা চলে আসবে, ভাবতেও পারেননি তিনি , তাও আবার এভাবে । হ্যাঁ, একটা কান্নাভেজা ফোনকল তিনি আশা করছিলেন , কিন্তু আরেকটা আত্মপ্রতিকৃতি তার কাছে আশাতীত ছিল । তারপরেও এটাতেই তার বেশি ভাললাগছে, বেশি আপন মনে হচ্ছে ।





No comments:

Post a Comment

আরো যা দেখতে পারেন