Sunday 24 May 2020

প্যারাসাইট ইভ ( Parasite Eve) by হিদেয়াকি সেনা ( Hideaki Sena)- 2




.

ছটার দিকে তাদের আইসিইউতে ঢুকতে দেবার অনুমতি দেয়া হল

ঘরটাতে ঢুক্তেই তাদের বলা হল ধূসর রঙের স্টেরিলাইজড গাউন আর স্পেশাল মাস্ক পরে নিতে একই সাথে তাদের হাত পা ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিতেও বলা হল তোশিয়াকির কাছে ব্যাপারটা নতুন কিছু নয় তাকে এক্সপেরিমেন্টের জন্য এভাবে অনেকবার প্রস্তুত হতে হয়েছে তাই ব্যাপারটা তার কাছে বেশ ভালোভাবেই পরিচিত কিয়োমির বাবাও সার্জন হওয়ার কারনে তার কাছে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না একমাত্র কিয়োমির মায়ের কাছে ব্যাপারটা বিরক্তিকর লাগলো অনেকটা রাগে গজগজ করতে করতে তিনি গাউনটা টানাটানি করে পরতে লাগলেন

বিশাল বড় ঘর ছিল সেটা বেশ কয়েকটা স্ট্রেচার দেয়ালের একপাশে লাগিয়ে রাখা হয়েছে স্ট্রেচারের সংখ্যার প্রায় অর্ধেক সংখ্যক ব্লাড ট্রান্সফিউশান যন্ত্র ছিল ঘরটাতে দেয়ালের একপাশে দুটো মনিটর লাগানো ছিল, যা থেকে একগাদা তার বেরিয়ে ছিল এত আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও আইসিইউ এর অন্যান্য বিছানাগুলো ফাঁকা ছিল ফলে গোটা আইসিইউটা ঘুমিয়ে আছে বলে মনে হয়তে লাগলো 

কিয়োমিকে কাছাকাছি একটা বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছে তার নাকের ভেতর কয়েকটা টিউব ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে তোশিয়াকি টিউবগুলো কোথায় চলে গিয়েছে তা দেখার চেষ্টা করলো টিউবগুলো তার নাক থেকে বেরিয়ে বেরিয়ে একটা ছোটোখাটো বালতির মত বাক্সে ঢুকেছে, তারপর সেখান থেকে একটা সাদা রঙের যন্ত্রে গিয়ে ঢুকেছে যন্ত্রটায় বেশ কয়েকটা বোতাম একটা মিটার লাগানো ছিল মিটারটার কাঁটা একতা নির্দিষ্ট তালে বামে ডানে ঘুরছিল যন্ত্রটা আকারে খুব একটা বড় ছিল না তবে মিটারের কাঁটা একটু লাফিয়ে উঠলেই সেটাহিসসকরে শব্দ করে উঠছিল ওটাই কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের যন্ত্র, ডাক্তার তাদের জানালো দেয়ালের মনিটরগুলোতে কিয়োমির ব্রেন ওয়েভ দেখা যাচ্ছিল

তারা সবাই কিয়োমির বিছানার চারদিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে লাগলো তার মাথাটা মুড়িয়ে ন্যাড়া করে দেয়া হয়েছে এখন সেটা কাপড় আর ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে দেয়া হয়েছে দেহের বাকি অংশটা একটা চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল ফলে আর কোনো আঘাত দেখা যাচ্ছিল না মাথায় আঘাতের কয়েকটা চিহ্নের কথা বাদ দিলে তাকে সম্পূর্ন সুস্থ, স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল

আইসিইউ থেকে বের হবার পর ডাক্তার তাদেরকে তার অফিসে নিয়ে গেলেন তাদেরকে বসতে অনুরোধ করে তিনি নিজের ডেস্কে বসলেন তার ডেস্কের পাশের দেয়ালের লাইট বক্সে কিয়োমির বেশ কয়েকটা সিটি স্ক্যানের ফিল্ম লাগিয়ে রাখা ছিল তাদেরকে সেটা দেখিয়ে ডাক্তার কিয়োমির বর্তমান অবস্থাটা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করতে লাগলেন তিনি বললেন, ব্রেন ডেথ হচ্ছে এমন একটা অবস্থা, যখন মস্তিষ্কে রক্ত সরবারহ বন্ধ হয়ে গেলে দেখা দেয় অবস্থায় মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয় অবস্থা থেকে ফিরে আসা অসম্ভব একটা ব্যাপারজিনিসটাভেজিটেটিভ অবস্থাথেকে খানিকটা ভিন্নকারণ, অবস্থাতেও মস্তিষ্ক কাজ করেতাদের হাসপাতালে ব্রেন ওয়েভ রেসপন্স ইন্সপেকশন এর পাশাপাশি আরো অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে

আজ পাঁচটার দিকে যে টেস্ট করানো হয়েছিল, তার রেজাল্টটা এই যে দেখুন

ডাক্তার তাদের দিকে একটা স্প্রেডশিট বাড়িয়ে দিলেনসেটাতে কিয়োমির অডিটরি ব্রেন স্টেম রেসপন্স, পিউপিলারি ডায়ালেশন আর শ্বাসপ্রশ্বাসের বেশ কিছু তথ্য ছিলডাক্তার সবকিছুই বেশ বিশদভাবে ব্যাখ্যা করলেনসংক্ষেপে তিনি তাদের জানালেন যে, কিয়োমির ব্রেন একটিভিটির কোনো পরিবর্তন হয়নি বললেই চলেআর শ্বাসপ্রশ্বাস সে নিজে থেকে আর নিতে পারছে নাযদি যন্ত্রটা খুলে নেয়া হয়, সে আর শ্বাস নিতে পারবেনা, হার্ট বন্ধ হয়ে যাবে, শরীরের তাপমাত্রা কমতে কমতে একেবারে তলানিতে চলে যাবে

ফর্মটার ডানদিকের জায়গাটা এখনো ফাঁকা পড়ে আছেসেখানে পরবর্তী টেস্ট রেজাল্টগুলো লেখা হবে

আমরা মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করব যে, পরবর্তী টেস্টেও এরকম রেজাল্ট পাই কিনাততক্ষনে প্রথম টেস্ট হবার প্রায় ছয়ঘন্টা পেরিয়ে যাবেআর এভাবেই বোঝা যাবে আমাদের কোথাও কোনো ভুল আছে কিনা

তোশিয়াকি ডাক্তারের কথাগুলোতে বেশি মনোযোগ দিচ্ছিল নাতার মাথা থেকে সে এখনো কিয়োমির শান্তিপূর্ন সেই চেহারাটা সরাতে পারছে না

আমরা আপাতত তাকে আগের মতই কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসে রাখছিতবে আমি উপদেশ দেব, আপনারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিন কখন তাকে সেটা থেকে ছাড়িয়ে নেবেনততক্ষন পর্যন্ত আমরা আপনাদের আশ্বস্ত করছি, আমরা তাকে সর্বোচ্চ সেবাটা দিয়ে যাবতাকে আমরা পুষ্টিকর আইভি ড্রপ দেবআর কিছুসময় পরপর তার শোয়ার ভঙ্গিটাও পরিবর্তন করে দেব, যাতে তার গায়ে কোনোধরনের দাগ না পড়ে যায়আমি আপনাদের বোঝানো চেষ্টা করছি যে, যদিও তিনি শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছেন, সত্যিকার অর্থেকিয়োমি…….আর বেঁচে নেই…”

সন্ধ্যাবেলায় সকলে মিলে আইসিইউতে ফিরে গিয়ে কিয়োমির পাশে গিয়ে বসলতার বাবা ততক্ষনে মনটাকে মানিয়ে কিছুটা স্থির করতে পেরেছেনতার মা অবশ্য এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না কিছুই, টপাটপ চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে অনবরতএই একদিনেই তার চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছেতার ক্লান্ত শরীর দেখে বোঝা যাচ্ছে, শরীরে তার একটুকু শক্তিও বাকি নেইকিয়োমির বাবা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তার স্ত্রীর হাত ধরে তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন

তোশিয়াকির চোখে একবিন্দু ঘুম আসছিল নাতাই সে রয়ে গেল


দশটার দিকে একজন নার্স এসে কিয়োমির গোটা শরীর একটা উষ্ণ টাওয়েল দিয়ে মুছে দিলেনহাস্যোজ্বল নার্সটা বেশ ভালভাবে মনযোগ দিয়ে কাজ করছিলেন। তার বয়েস আর কত হবে, বিশের ঘরে হয়ততাকে এভাবে কিয়োমির সেবা করতে দেখে তোশিয়াকি বুকে একটা ব্যথা অনুভব করলো

তিনি নার্সকে সাহায্য করতে গিয়ে কিয়োমির গায়ের উষ্ণতা টের পেলেনতার মুখে কিছুটা লালা জমতে শুরু করেছেসেটা বাদ দিলে তার ত্বক আগের মতই আছে, কিছুটা ধূসর ছোপ পড়েছে এই যাতোশিয়াকি আগে কখনো কাউকেভেজিটেটিভঅবস্থায় থাকতে দেখেনিতাই তার মেনে নিতে কষ্ট হল যে, কিয়োমি আসলেই অসুস্থ

প্লিজ আপনার স্ত্রীর সাথে কথাবার্তা বলুননার্স হাসিমুখে মিষ্টিস্বরে বললেন তোশিয়াকিকেসে তখন কিয়োমির বেডপ্যান খালি করছেকথাবার্তা বললে তার মনটা ভাল হয়ে যাবে

তোশিয়াকি নার্সের উপদেশটা অমান্য করলেন নাতিনি শক্ত করে কিয়োমির হাতটা ধরে গোটা রাত একটানা কথা বললেনতার সেদিন কি কি হয়েছে তা বললেন, অনেকগুলো স্মৃতিচারন করলেন, আর বললেন কেন তিনি কিয়োমিকে প্রচন্ড ভালবাসেনকিয়োমির কোন জিনিসটা তার সবচেয়ে ভাললাগে, সেটা জানাতেও ভুললেন নাতার মনে হল, কিয়োমির শরীর থেকে একটা আরামদায়ক উষ্ণতা তার শরীরে প্রবেশ করছেকিয়োমির বুক শ্বাসপ্রশ্বাসের কারনে নিয়মিতভাবে ওঠানামা করতে লাগলোগোটা আইসিইউ জুড়ে কেবল নির্দিষ্ট সময় পরপর কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের যন্ত্রটারহিসসশব্দটা প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো


তোশিয়াকি পরের দিন খুব সকালবেলা ইউনিভার্সিটিতে চলে গেলেনতার খুব একা থাকতে মন চাচ্ছিলোআশেপাশের রাস্তাঘাট তার কাছে সবই কেবল ছায়া আর অবয়বহীন মনে হচ্ছিলখুব ধীর গতিতে গাড়ি চালাতে চালতে তিনি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলেনক্যাম্পাসের গ্রাউন্ডে একটা হালকা কুয়াশা বিরাজমান ছিলতোশিয়াকি সেই আর্দ্র আবহাওয়ায় শ্বাস টেনে নিয়ে বিল্ডিং প্রবেশ করলেনকোনোদিকে না তাকিয়ে তিনি সোজা তার ল্যাবে গটগট করে চলে গেলেনএই ভোর বেলাতে ল্যাবে কেউ ছিল নাতিনি তার ডেস্কে গিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেনদীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি জানালার দিকে তাকালেনবাইরের রাস্তাটা কেমন জানি ফ্যাকাশে মনে হচ্ছেরাস্তাটা দেখে মনে হচ্ছে সেটা যেন দিগন্তে মিলিয়ে গিয়েছে

তার মনে কিয়োমির সেই অচেতন মুখটা আবার ভেসে উঠল

এর আগেও তোশিয়াকির জীবন থেকে অনেক প্রিয় মানুষজন বিদায় নিয়েছেনসেটা রোগের কারনেও হয়েছে, বার্ধ্যকের কারনে হয়েছেতাই তিনি ভেবেছিলেন, মৃত্যু জিনিসটা হয়ত তার কাছে পরিচিত হয়ে গিয়েছেকিন্তু তার প্রিয় স্ত্রীকে হাসপাতালের স্ট্রেচারে অচেতন ভাবে শুয়ে থাকতে দেখে তার ভুলটা ভেঙ্গে গিয়েছিল

কিন্তু সত্যিই কি সে মারা গিয়েছে?

তোশিয়াকি ঘোরের মধ্যে একটা একটা আশাবাদী চিন্তা করা শুরু করে দিলেন, তার স্ত্রী বেঁচে আছে এখনোগতরাতে কিয়োমির শরীরের সেই উষ্ণতা তার এখনো মনে আছে

ব্রেন ডেথ সম্পর্কে টিভিতে, খবরের কাগজে আর মেডিকেল জার্নাল থেকে যতটুকু জানা যায়, ঠিক ততটাই জানেন তিনিএজন্যই তিনি এখনো আশাবাদীব্রেন ডেথকে সবাই সেন্টিমেন্টাল দিক থেকে বিবেচনা করে, অথচ ব্যাপারটা বিজ্ঞানের দিক দিয়ে ভাবা উচিতআগে যখন দেখতেন একজন রোগীর বেঁচে থাকার জন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ট্রান্সপ্লান্ট করা দরকার, তিনি ভাবতেন সেগুলো ব্রেন ডেথ ডোনারদের থেকে নিয়ে নিলেই তো হয়

আজ চিন্তাটা মাথায় আসতেই তার দাঁত অজান্তেই কিড়মিড় করে উঠলকেউ তার প্রিয় কিয়োমির দেহ থেকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বের করে নিচ্ছে- দৃশ্য তিনি কল্পনাও করতে পারলেন না  

তোশিয়াকি প্রায় প্রতিদিনই ইঁদুর কেটে এক্সপেরিমেন্ট করতেনতারমানে এই না যে, ব্যাপারটাতে তিনি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেনএকটা মানুষকে কেটে তার থেকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বের করে আনা- ব্যাপারটা ভাবতেও তার অস্বস্তিবোধ হতআর এখন, তার ল্যাবরেটরির ইঁদুরের কাটাকাটির দৃশ্যের সাথে তার প্রাণপ্রিয় কিয়োমির দৃশ্যটা যেন মিশে যাচ্ছে তার কল্পনার চোখে; ল্যাবরেটরির ইঁদুরের কিডনির সাথে কিয়োমির কিডনি

কিডনি

তোশিয়াকি চোখ বন্ধ করে ফেললেন

গতবছরই কিয়োমি কিডনি ডোনার হিসেবে রেজিস্টার করিয়েছিলতার বেশ ভালভাবেই মনে পড়ছে

তোশিয়াকির কাছে এই ডোনার হবার ব্যাপারটা অনেক প্রশংসাযোগ্য ব্যাপার লাগে হ্যাঁ, যদি কিয়োমির কিডনি কোনো কাজে লাগে, তবে সেটা খুবই ভাল একটা ব্যাপার হবেকিন্তুএখনো কিয়োমির শরীরের উষ্ণতাটা চলে যায়নি, হৃৎপিন্ড এখনো স্পন্দন থামায়নি এরকম অবস্থায় কিডনি ডোনার এর মত চিন্তাভাবনা মাথায় আসতেই চায় না এখনো তার মনে হচ্ছে, স্ত্রী বেঁচে যাবে তিনি এখনো দ্বিধাহীন যে, তার স্ত্রী বেঁচে আছে এবং হাসপাতাল থেকে বেঁচেই ফিরবে

কিছুক্ষন পর তোশিয়াকি চোখ খুললেন বাইরের রাস্তাঘাট ও ক্যাম্পাস গ্রাউন্ড থেকে ততক্ষনে কুয়াশা ভাবটা কেটে গিয়েছে চোখ ধাঁধানো সূর্যের আলোয় বাইরের রহস্যময় কুয়াশাটা বিদায় নিচ্ছে দূর থেকে কাকের ডাকও শোনা গেল নতুন দিনের সূচনা হচ্ছে অধিকাংশ মানুষের জন্যই ব্যাপারটা হয়ত নতুন কিছু না কিন্তু তোশিয়াকির জীবনে আজকের দিনটা কোনোমতেই ভুলে যাওয়ার মত নয় আজকের দিনেই সে তার স্ত্রীর দুর্ঘটনার বাস্তবতা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল এই ঘটনাটা তার জীবনে অমোচনীয় একটা দাগ ফেলে যাবে

তার ফিরে যেতে হবে তার আগে তিনি তার সেল কালচারগুলোর কি অবস্থা, তা দেখতে হেঁটে হেঁটে কালটিভেশন রুমে গেলেন যদি সেগুলো ঠিকঠাক থাকে, তবে নতুন এক ব্যাচ দিয়ে সেগুলো পাল্টে দিতে হবে

তিনি স্লাইডগুলো মাইক্রোস্কোপের নিচে নিয়ে দেখলেন অবশ্য তাতে তেমন লক্ষ্যনীয় কিছু ছিল না অন্যমনস্কভাবে তিনি হাইব্রিডোমা আর ক্যানসার কোষগুলোর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলেন আচমকা, কোনো ধরনের সাবধানবাণী ছাড়াই তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল

তোশিয়াকি মাইক্রোস্কোপ থেকে চোখ তুললেন স্লাইডে দেয়া লাল রঙের নির্দেশক দ্রবণের দিকে দিকে তাকিয়ে তিনি চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থাকলেন মুখ থেকে অবাক হওয়া স্বরে একটা বিড়বিড় শব্দ ফসকে গেল

ওহ, কিয়োমি…”

তার হার্টের গতি বেড়ে গিয়েছে তিনি তড়াক করে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন খুব দ্রুত সেই বুদ্ধিটা তার মগজের ভেতর ছড়িয়ে গেল আস্তে আস্তে সরে যেতে থাকলেও তার মনটা পড়ে রইল টেবিলে রাখা সেই স্লাইডগুলোর ওপর
হ্যাঁ, এটা সত্য যে কিয়োমি মস্তিষ্কে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে তারপরও তিনি যখন তাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন, তার শরীরের উষ্ণতাটা তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন

তারমানে তার ভেতরের সবকিছু মারা যায়নি

তখনো তার চোখ দুটো স্লাইডগুলোতে আঠার মত লেগে আছে তোশিয়াকিশক্ত করে হাত মুঠো করে ছাদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন

তার পরিকল্পনার জন্য এক্ষুনি হাসপাতালে যেতে হবে….কিন্তু হাসপাতাল যে এখান থেকে অনেক দূরে

তিনি চটজলদি গাড়িতে উঠে গ্যাস পেডালে জোরে চাপ দিয়ে গিয়ার প্লাটে নিলেন তখনো তিনি বিড়বিড় করে কিয়োমির নাম বলেই চলেছেন অনেক কিছু করতে হবে কিয়োমির বাবা মা কিডনি ডোনেট এর ব্যাপারে কি ভাবেন তা দেখতে হবে তারপরে তার একজন পুরোনো সার্জন বন্ধুর সাথে বন্ধুত্বটা আবার জাগিয়ে তুলতে হবে তারপর তাকে যেভাবেই হোক তার পরিকল্পনাতে রাজি করাতে হবে তার মনে মনে অবশ্য তিনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে, তার পরিকল্পনাটা কাজে দেবে কিয়োমি এখনো বেঁচে আছে জিনিসটা উপলব্ধি করতে পেরে তার চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু বের হতে লাগলো

আজ থেকে আমরা সবসময় একসাথে থাকব প্রিয়া

তার হৃদয় যেন আনন্দে কাঁদতে শুরু করলো



                                                         

তোশিয়াকি আর তার শ্বশুর বেশ অস্থিরভাবে মনোযোগ দিয়ে কিয়োমির দ্বিতীয় টেস্ট হতে দেখলো যে ডাক্তার ইনচার্জ ছিলেন, মানে গতকালকেই যার সাথে তাদের দেখা হয়েছে, তিনি আরেকজনের সাথে কাজটা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন তোশিয়াকি কোনো বড়সড় টেস্টের জন্য নিজে প্রস্তুত করেছিলেন, কিন্তু টেস্টটা দেখে তিনি বরং হতাশই হলেন টেস্টের জন্য তারা কিয়োমিকে একটা হেডফোন পরিয়ে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় খোঁচা মেরে তার প্রতিক্রিয়া দেখার চেষ্টা করছিলেন কিয়োমির ব্রেন ওয়েভ আগের মতই রইল ইনচার্জে থাকা ডাক্তার সবকিছু চার্টে টুকে নিলেন তোশিয়াকি রাগে গজগজ করে বলতে লাগলেন, পরীক্ষাটা একেবারে অবৈজ্ঞানিক ছিল

সবকিছুর ফলাফল নেগেটিভ পাওয়া গেল সব কাজ শেষে ডাক্তার তার হাতে ফর্মটা তুলে দিলেন তার মুখের ভংগি দেখে বোঝা গেল, তিনি নিজেও ব্যাপারটাতে নিশ্চিত তোশিয়াকি চার্টটা কিয়োমির মুখের সামনে ধরে আলতো করে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে চার্টটা ফিরিয়ে দিলেন ডাক্তার ফর্মটা ফেরত নিয়ে সেখানে স্বাক্ষর করে দিলেনপরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমরা নিশ্চিত হতে পেরেছি যে, মিসেস কিয়োমি ব্রেন ডেড অবস্থায় চলে গিয়েছেন

আচ্ছা

তোশিয়াকি চাইলে আরো সুন্দর করে একটা উত্তর দিতে পারতেন, কিন্তু মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে নিজের নিস্পৃহতায় অবশ্য তিনি নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন

ঠিক আছে এখন আপনারা কিছুক্ষনের জন্য আমার অফিসে আসুন কয়েকটা কাজ আছে, সেরে নিতে হবে

অফিসরুমে একটা মহিলা বসে অপেক্ষা করছিলেন তাদের ভেতরে ঢুকতে দেখে তিনি উঠে দাঁড়ালেন তাদের মাথা নিচু করে অভিবাদন জানালেন তোশিয়াকি অন্যমনষ্কভাবে সেটার উত্তর দিলেন

ইনি আজুসা ওদাগিরি, আমাদের ট্রান্সপ্ল্যান্ট কমিটির প্রধানডাক্তার তাদের সাথে মহিলার পরিচয় করিয়ে দিলেনআমি জানতে পেরেছি যে, মিসেস কিয়োমি একজন রেজিস্টার্ড কিডনি ডোনার তাই আমি তাকে আমার অফিসে ডেকেছি

ওদাগিরি তাদের হাতে একটা বিজনেস কার্ড তুলে দিলেন স্যুট পরা ফিটফাট মহিলাকে দেখে তোশিয়াকির চেয়েও কমবয়স্ক মনে হচ্ছিল অবশ্য চলাফেরা ভাবভঙ্গিতে যে তার মধ্যে একজন দক্ষ কর্মীর আভা প্রকাশ পাচ্ছে, তা অস্বীকার করা যাবে না তার মুখের গঠন দেখে মনে হচ্ছে, তাকে বিশ্বাস করা যাবে আরেকবার মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানিয়ে তিনি বললেন, তাদের সাথে পরিচিত হতে পেরে তিনি আনন্দিত  

ডোনার যদি উপস্থিত, মানে জীবিত থাকেন তবে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা সম্ভব নয় একেবারে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে থাকা ডোনার কিংবা ব্রেন ডেথের শিকার রোগিদের থেকেই কিডনি নেয়া হয়ে থাকে ইমার্জেন্সী রুমের ডাক্তাররা সেসব রোগীর ক্ষেত্রেও সর্বাত্মক চেষ্টা করেন, যদিও সেটা তাদের অনিচ্ছায় কারণ যদি একজন ট্রান্সপ্লান্ট সার্জন সোজাসুজি রোগির পরিবারের সাথে কিডনির জন্য যোগাযোগ করেন, তবে ব্যাপারটা তাদের অনুভূতিতে আঘাত হানবে এরকম সংবেদনশীল বিষয়ে দুদিকেই ভারসাম্য রক্ষার জন্য একজন প্রয়োজন ছিল আর সেজন্যই ওদাগিরির মত ট্রান্সপ্লান্ট কোর্ডিনেটরের দরকার পড়ে তার কাজ শুধু এটুকুই নয়, আরো অনেক দিক তাকে সামলাতে হয় কিন্তু ডাক্তারদের সময়ের অভাব, রোগীর পরিবারের সাথে দেখাসাক্ষাৎ, পরিবারকে সমবেদনা জানানোমোটামুটি এগুলোই তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন কাজ

তোশিয়াকি আর তার শ্বশুর শাশুড়ি একসাথে সোফাতে বসলেন

আমি সোজাসুজি কাজের কথায় চলে যাচ্ছি কিয়োমির কিডনি দুটো দিয়ে আমরা দুজন ডায়ালাইসিস রোগির জীবন বাঁচাতে পারবো সিআরএফ(CRF) বা ক্রনিক রেনাল ফেইলিওর রোগটা যে কারো হতে পারে বাচ্চাদেরও ছাড় দেয় না এই দূরারোগ্য ব্যাধি দুঃখের কথা হচ্ছে, এর কোনো চিকিৎসা নেই কেবল ডায়ালাইসিস এর মাধ্যমে শরীরের ভেতরের বর্জ্য পদার্থটা বের করে দেয়া যায় কেবল কিন্তু নানান কারনে রোগীরা সামাজিক জীবন যাপনের আশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তাদের খাবার-দাবারেও নানান নিষেধাজ্ঞা পালন করতে হয় তবে একটামাত্র কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করলেই রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে যেতে পারে আমি ব্যাপারে আপনাদের আশ্বস্ত করছি, এই কিডনি দুটো কোনোমতেই নষ্ট হবে না

তোশিয়াকি মনোযোগ দিয়ে তার কথাগুলো শুনলেন মনের ভেতর কথাবার্তাগুলো গুছিয়ে এবার বিস্তারিত ভাবে বলা শুরু করলেন :

আমি আপনার কথা বেশ ভালভাবেই বুঝতে পেরেছি যে, কিয়োমির কিডনি দুটো অন্যদের জীবন বাঁচাতে পারবে আমি ব্যাপারে আপনার সাথে সম্পূর্ন একমত আমিও চাই কাজেই সেগুলো ব্যবহৃত হোক কিডনি দোয়ার হবার ইচ্ছাটা তারই ছিল তাই তার মতের প্রতি সম্মান জানানো উচিত বলে আমি মনে করি তাই অবস্থায় আপনার যা ভাল মনে হবে, তাই করুন আমার কেবল একটাই শর্ত আছে কিডনি বাদে আর কিছুই যেন তার শরীর থেকে সরানো না হয় কারণ, তাতে কিয়োমির সমর্থন ছিল কিনা তা আমি বলতে পারছি না তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি কিছুই করতে রাজি নই, এই যা

তোশিয়াকির মনে হতে লাগলো, সোফায় বসে একদল অভিনেতা অভিনয় করে যাচ্ছে একটানা কথাগুলো বলার পর তিনি তার শ্বশুরের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য তার দিকে তাকালেন তার শ্বশুর চোখ বন্ধ করে আলতো করে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন তোশিয়াকির কথায়

আপনাদের কথাবার্তায় এবং সিদ্ধান্তে মুগ্ধ হলাম আপনাদের ধন্যবাদ জানালেও কম হয়ে যাবেওদাগিরি কৃতজ্ঞতাতে আবার মাথা নুইয়ে তাদের অভিবাদন জানালেনআমার সামর্থ্য অনুযায়ী আপনাদের প্রতিটা মুহূর্ত সাহায্য করার জন্য আমি সবসময় আপনাদের পাশে থাকব

তোশিয়াকি তখন ওদাগিরির বাড়িয়ে দেয়া অনুমতিপত্রটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন এই পাতলা কাগজটার মাঝখানে যে কয়টা লাইন লেখা ছিলো :

                   … … … … … … … … … …
আমি এতদ্বারা সম্মতি দিচ্ছি যে, সার্জারির মাধ্যমে উল্লিখিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ
টিস্যু অপসারণ করা যাবে … … … … … …

এবং সেটা ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্যই রোগীর শরীর থেকে অপসারণ করা হবে



ছোট, কাঠখোট্টা এই বাক্যটা অনুমতিপত্রের ঠিক মাঝখানে প্রিন্ট করা হয়েছে সেটার খালি জায়গাটার ওপরে তোশিয়াকি তার স্ত্রীর নাম, ঠিকানা, জন্মতারিখ, লিঙ্গ সবকিছু ঠিকঠাকমত লিখে দিলেন তারপর মনের সবটুকু জোর একত্র করে কিডনি শব্দটা গোল দাগ দিয়ে দিলেন  দাগ দেবার পর জোরেসোরে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন তারপর আজকের তারিখ, সাক্ষী হিসেবে নিজের নাম, ঠিকানা আর আত্মীয়তার সম্পর্কটাও লিখে দিলেন

আর এখানে আপনার সিল লাগবে

ওদাগিরি তার লম্বা, ফ্যাকাসে আঙ্গুল তাক করে অনুমতিপত্রের একেবারে শেষের দিকটা দেখিয়ে দিলেন

তোশিয়াকি শার্টের পকেট থেকে সিলটা বের করলেন ওদাগিরি ওদিকে ব্যাগ থেকে একটা ইঙ্ক প্যাড বের করে তার সামনে রেখে দিয়েছেন তোশিয়াকি সিলটা প্যাডে শক্ত করে চাপ দিয়ে কাগজটায় সিল মেরে দিলেন এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হতে লাগলো, ব্যাপারটা ঠিক হলো কিনা এইমাত্র তিনি পাকাপাকিভাবে তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর শরীর থেকে কিডনি অপসারনের ব্যবস্থা করলেন এরকম গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার কেবলমাত্র একটা কাগজে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে হয়ে গেলবিশ্বাসই হচ্ছে না তারপরেই, যা হয়েছে ভালর জন্যই হয়েছে


তোশিয়াকি মাথা থেকে দুশ্চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলেন একেবারে শেষের দিকে এসে এরকম দুশ্চিন্তা মানায় না কিছুক্ষন আগেই না তিনি মনে মনে ঠিক করলেন যে, এভাবে আগালে তার স্ত্রীর আয়ু বাড়ানো যাবে? এর মাধ্যমেই না তার স্ত্রী সবসময় তার পাশে থাকবেন? কিয়োমি কি শুধু তার শরীরের বাহ্যিক দিকটাই, নাকি তার দেহের প্রত্যেকটা জীবিত কোষই কিয়োমি? এখন তাকে এই প্রশ্নের উত্তর বের করতে হবে

তোশিয়াকিকে খুব দ্রুত কাজ শুরু করতে হবে

ঠিক তখনই তার শরীরের সেই উত্তাপটা ফিরে এল ঠিক আগের মত সেই উত্তাপ যখন ডাক্তার তাকে জানাচ্ছিলেন যে কিয়োমির ব্রেন ডেথ হয়েছে, তখন ঠিক এটাই তার শরীরে অনুভূত হচ্ছিল

অফিস থেকে সবাই যখন বের হয়ে যাচ্ছিল, তখন তোশিয়াকি নিঃশব্দে তার শ্বশুরের পাশ কাটিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেন কিছুটা ফিসফিস করে তাকে বললেন, “কিয়োমির ব্যাপারে আমার একটা অনুরোধ আছে

হ্যাঁ বলুন

আগে দয়া করে পুরোটা শুনবেন ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে রাখতে চাচ্ছি… … আমি কিয়োমির কিডনির পরিবর্তে একটা জিনিস চাই

পরিবর্তে? কী…”

ডাক্তার তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকালেন তোশিয়াকি তার কম্পনরত হাতটা ডাক্তারের কাঁধে রেখে ফিসফিস করে বললেন,


আমার কিয়োমির লিভারটা লাগবে আমি সেটাকে একটা প্রাইমারী কালচার বানাতে ব্যবহার করব



No comments:

Post a Comment

আরো যা দেখতে পারেন