Monday 25 May 2020

প্যারাসাইট ইভ ( Parasite Eve) by হিদেয়াকি সেনা ( Hideaki Sena)- 3






                                                .

ওয়ার্ড ডিউটির পাট চুকিয়ে কুনিও শিনোহারা ক্লিনিকাল রিসার্চ সেন্টার এর পাঁচতলায় অবস্থিত সার্জারি ডিপার্টমেন্টে ফিরে এলেন এলিভেটরে করে নিচে নেমে হাতের ডানদিকে গিয়ে নিজের অফিসের দরজাটা খুললেন

নিজের কাঁধটা ম্যাসাজ করতে করতে প্রাণহীন ঘরটা পার করে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে পড়লেন আড়চোখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, ঘড়িতে তখন :৩০ বাজে

তার সেক্রেটারি ডেস্কে দুটো মেমো রেখে গিয়েছে তিনি একটা মেডিকেল আর্টিকেল পড়তে চেয়েছিলেন( কিন্তু সেটা পাওয়া যায়নি), আরেকটা মেমো রেখে গিয়েছে একটা ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি শিনোহারা তার ধবধবে সাদা ল্যাব কোটের পকেট থেকে একটা ছোট সাইজের নোটপ্যাড বের করে টেবিলে আস্তে করে ছুঁড়ে ফেললেন বুঝতে পারলেন, আরেকবার ম্যাসাজ করার দরকার কাঁধটা মনে হচ্ছে, সারাদিনের সকল ধকল জমা হয়েছে সেখানে ব্যাপারটা অবশ্য তার জন্য নতুন কিছু না, বরং অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছেধুর, অফিস থেকে চেম্বারটা আসলেই খুব বেশি দূরেতিনি বিড়বিড় করে বললেন বলেই টের পেলেন, কথাগুলো তিনি একটু বেশিই জোরে বলে ফেলেছেন লজ্জ্বা ঢাকতে আশেপাশে কেউ আছে কিনা, তা দেখে নিলেন

তবে কাউকে কাছে না দেখতে পেয়ে তিনি বরং একটু অবাকই হলেন সময়টায় তার গুটিকয়েক রিসার্চ স্টুডেন্ট থাকার কথা হয়ত চেম্বার থেকে একটু আগে বেরিয়েছে ওরা খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে তবেই ফিরবে

মগে ইন্সট্যান্ট কফি ঢেলে তিনি আবার ডেস্কে বসলেন এড্রেস বুকটা বের করে কাগজে খসখস করে কিছু নোটস লিখে রাখলেন ঠিক সময়েই টেলিফোনটা বেজে উঠল নাহ, ইন্টারনাল কল না তো এটা টেলিফোনের মৃদু আলোতে বেজে ওঠাতে ব্যাপারটা পরিষ্কার, বাইরে থেকে কেউ ফোন দিয়েছে শিনোহারা উঠে দাঁড়ালেন ফোনের কাছে হাতে কফির মগটা নিয়েই এগিয়ে গেলেন কফিতে একটা চুমুক দিয়ে অবশেষে ফোনটা ওঠালেন

হ্যালো, সার্জারি ডিপার্টমেন্ট থেকে বলছি

হ্যালো, আমি নাগাশিমা বলছি… …ফার্মাসিউটিকাল স্কুল থেকে… …”

কী? আরে, নাগাশিমা নাকি! ”

অপর পাশের পরিচিত কন্ঠস্বরটা শুনে মনে মনে বেশ উৎফুল্ল হলেন তিনিপিএইচডি শেষ করতে দুজনেই একই ফার্মাসিউটিক্যাল সেমিনার কোর্স নিয়েছিলেনআর সেভাবেই শিনোহারার সাথে তোশিয়াকির সম্পর্কটা গড়ে উঠেছিল স্টেট এক্সাম পাশ করলেও একজন মেডিকেল গ্র্যাজুয়েটকে পিএচইডি করার সুযোগ দেয়া হয়না তাকে বেশ কিছুদিন ডিসপেনসারিতে থাকতে হয়; সেসময়টা আর্টিকেল লেখালেখি আর পরীক্ষা পাশ করতে করতেই চলে যায় দিনগুলোতে, ২৯ বছরের শিনোহারার টার্গেট ছিল-যেভাবেই হোক পিএইচডি পেতেই হবে সিনিয়রদের চাপিয়ে দেয়া কাজে ডুবে যাওয়ার মত অবস্থা হলেও তিনি সেল কালটিভেট করা চালিয়ে গিয়েছিলেন শিনোহারার টপিক ছিললিভারের কোষে ক্যান্সার জিন জন্মানো পরীক্ষা করার জন্য তিনি ইঁদুরের লিভার থেকে নমুনা সংগ্রহ করে প্রাইমারী কালচার সম্পন্ন করেছিলেন তারপর সেটাতে ক্যান্সার তৈরি করে এমন ড্রাগ যোগ করে প্রোটিন তৈরি হবার ঘটনাটা পর্যবেক্ষন করছিলেন কাজটা একেবারেই বস্তাপচা হয়েছিল, কিন্তু সময়ে সেটা নিয়ে ততটা কাজ হয়নি বলে এই টপিক দিয়ে ভাল একটা ডক্টরাল থিসিস করা সম্ভব ছিল তোশিয়াকির সেমিনার কোর্স যে সহকারী অধ্যাপক নিচ্ছিলেন, তিনি প্রোটিন শনাক্তকরনের একটা পদ্ধতি বের করেছিলেন

তোশিয়াকি নিজেও সময়ে কেবল একজন গ্রাজুয়েট ছিল যদিও ক্যান্সার কোষ নিয়ে ঘাটাঘাটি করা তার এখতিয়ারে ছিল না, তারপরেও তিনি নিয়মিত ইঁদুরের লিভার দিয়ে প্রাইমারী কালচার করতেন কাজটা করতে করতে তিনি কাজে পারদর্শী হয়ে গিয়েছিলেন শিনোহারা তার কাছ থেকেই কাজটার খুঁটিনাটি শিখে নিয়েছিলেন তাই দুইবছর রিসার্চ স্টুডেন্ট থেকে পরে ফিরে গিয়ে একবছরের মধ্যে ডক্টরেট সম্পন্ন করেছিলেন তোশিয়াকির সাথে যে অটুট বন্ধুত্বটা গড়ে উঠেছিল তা কিন্তু ভুলে যাননি প্রায়ই তার সাথে বিয়ার খেতে বের হতেন বয়সের পার্থক্য থাকলেও তারা দুজনেই একে অপরের সান্নিধ্য বেশ ভালভাবেই উপভোগ করতেন

শিনোহারা কানে টেলিফোন রিসিভারটা চেপে বড় একটা চুমুক দিয়ে কফি মুখে নিলেন আজকে রাতে হয়ত বের হওয়া সম্ভব নয়, তিনি মনে মনে ভাবলেন কিন্তু পরক্ষনেই তিনি টের পেলেন, কিছু একটা ঠিক নেই টেলিফোন তার থেকে কেমন জানি একটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা গোঙ্গানির শব্দ আসছিল শিনোহারার ভ্রু কুঁচকে গেল; কানেকশনের কোথাও সমস্যা হয়েছে নাকি? তিনি রিসিভারটা বেশ কয়েকবার নাড়ালেন আরো আশ্চর্যের ব্যাপার, তোশিয়াকি নিজের পরিচয় দেবার পর আর একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি শিনোহারার কফির মগ থেকে সর্পিলাকারে ধোঁয়া শূন্যে উঠে মিলিয়ে যাচ্ছিল এই নীরবতাটা আর সহ্য না করতে পেরে শিনোহারা আরেকটু হলেই কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তখনই রিসিভারে ক্ষীণ একটা গলা ভেসে এল

কিয়োমি মারা গিয়েছে

শিনোহারা কেঁপে উঠলেন মনের অজান্তেই তিনি তার খালি চেম্বারটার আশেপাশে তাকালেন ফ্লুরোসেন্ট আলো কয়েকবার মিটমিট করে থেমে গেল আগের মতই তার আলোয় আলোকিত করতে লাগলো চেম্বারটাকে প্রতিটা আলোর কণা বৃষ্টির ফোঁটার মত চারদিকে যেন ছড়িয়ে পড়ছিল

কী?”

শিনোহারা নিজের গলার আওয়াজ শুনে নিজেই চমকে গেলেন

কিন্তু কিয়োমি জীবিত আছে

আমি কিছুই ঠিক বুঝতে… …”

কিয়োমির লিভার থেকে তোমাকে নমুনা নিতে হবে আমি ডাক্তার নই, তাই আমি এই কাজটা ঠিকঠাক করতে পারব না তাই আমি তোমাকে কাজের ভার দিলাম তোমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারি?”

কিয়োমি? কী হয়েছে ওর?”

আমি এক্ষুনি তোমার ওখানে আসছি আমার কাজটা তুমি করে দেবে তো?”

কি যা-তা বলছ তুমি? এখন তুমি কোথায়?”

আমি শীঘ্রই আসছি

এটুকু বলেই তোশিয়াকি ফোনটা কেটে দিলেন

শিনোহারা শক্ত হাতে রিসিভারটা ধরে হতবুদ্ধি হয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলেন কি হচ্ছে, তিনি কিছুই বুঝতে পারছিলেন না অবশ্য এটুকু পরিষ্কার : তার প্রিয় বন্ধুর মানসিক অবস্থা ঠিক নেই

তোশিয়াকির শেষ কথাটা তার মনে পড়ল। আমি শীঘ্রই আসছি তারমানে কী? সে এখানে আসছে? বাইরের কোথাও থেকে সে ফোন দিয়েছে তারমানে এখন কোথায়?

ঠিক তক্ষুনি, ফোন কাটার পর একমিনিটও পার হয়নি, তার চেম্বারের দরজা খুলে গেল চমকে গিয়ে শিনোহারা পেছনে ফিরে তাকালেন তোশিয়াকি দরজার ওখানে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে দুর্বল একটা হাসি

শিনোহারার হাত থেকে মগটা পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল




.

মারিকো আনজাই ঘরে ডেস্কে বসে তার ম্যাথ হোমওয়ার্ক মনোযোগ দিয়ে করছিলো স্কুলের এক বান্ধবী তার প্রিয় পপ গায়কের একটা টেপ বানিয়ে দিয়েছিল সেটার গানের সাথে তাল মিলিয়ে সে গান গাইছিল হোমওয়ার্কটা বেশ কঠিনই ছিল, কিন্তু গণিত তার প্রিয় বিষয় হওয়ায় তার কাছে এই কঠিন জিনিসটা ভালই লাগছিল ঠিক যখনই সে অংকটা ধরতে পেরেছে, ঠিক তক্ষুনি টেলিফোন বেজে উঠল

আসছি বাবা, আসছি…” বিড়বিড় করতে করতে সে কিছুটা বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো হলওয়েতে টেলিফোনটা রাখা সেখানে হেঁটে যাওয়া শুরু করলো

ঘড়িতে তখন .২০ বাজে তার ঘরের বাইরে সবকিছু খুব বেশি ঠান্ডা আর প্রাণহীন মনে হচ্ছিল তার বাবা এখনো কাজ শেষে বাসায় ফেরেনি কিন্তু বিগত কদিন ধরেই তার আসতে আসতে প্রায় এগারটা বেজে যায়, তাই ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছু না তার বাবা এখন নিজ ডিপার্টমেন্টের হেড হওয়ার পর থেকেই ব্যাপারটা বেশি ঘটছে হ্যাঁ, তিনি চাইলেই নিজের রুটিনটা পরিবর্তন করতে পারতেন, আগে আগে আসতে পারতেন কিন্তু না করার কারণটা মারিকোর জানা ছিল বাবা তুমি আমার দিকে প্রয়োজনের বেশি তাকাতে চাও না, এই তো?

ফোনের বেজে ওঠার শব্দটা আর তার পায়ের স্লিপারের শব্দ- গোটা বাড়িতে কেবল দুটোই শব্দ টের পাওয়া যাচ্ছিল সে নিরাসভাবেই ফোনটা কানে দিলহ্যালো?”

শুভ সন্ধ্যা আমি ওদাগিরি বলছিআমি একজন ট্রান্সপ্ল্যান্ট কো-অর্ডিনেটর অসময়ে ফোন দেবার জন্য দুঃখিত, কিন্তু, মি. শিগেনরি আনজাই কী বাসায় আছেন?”   

মারিকোর দম বন্ধ হয়ে গেল সে অস্বস্তিভরে বাম হাতের দিকে তাকালো শার্টের হাতা গুটিয়ে রাখায় হাতের আইভি নেবার জন্য যে ফুটো ছিল, সেটা যেন তার দিকে ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে আছে হাতার আড়ালে যে আরেকটা ফুটো ছিল, সেটাও একই সাথে জ্বলতে শুরু করলো

বাবা এখনো কাজ থেকে বাসায় ফেরেননি… …” সে অস্বস্তি নিয়ে উত্তর দিল

তুমি কি মারিকো বলছো?”

উমমহ্যাঁ, আমি মারিকো বলছি

আহ, ভালই হয়েছে আসলে আমি তোমার জনই ফোন দিয়েছিলাম তোমার কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য একজন ডোনার পাওয়া গিয়েছে আমি সে সুখবরটা জানাতেই ফোন দিয়েছিলাম

তার হৃৎপিন্ড যেন লাফিয়ে উঠল। কিডনি পাওয়া গিয়েছে… …শব্দটা যেন তার শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে গেল

মারিকোর প্রথম ট্রান্সপ্ল্যান্ট ব্যর্থ হবার পর তার বাবা বেশ জোর খাটিয়ে মৃত ডোনারদের কিডনি নেবার লিস্টে তার নাম রেজিস্টার করে দিয়েছিলেন রেজিস্টারের পর কেবল দেড়বছর পার হয়েছে এত দ্রুত ডোনার পাওয়ায় সে বেশ অবাকই হল বিগত আঠার মাসের কথা তার মনে পড়া শুরু করলো… …

উপযুক্ত, তার ওপর মৃত- এমন ডোনার পাওয়া বেশ কঠিন ব্যাপার তারমানে আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে এই যা

ইয়োশিজুমি নামের একজন ডাক্তার তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে এই কথাগুলো বলেছিলেন কিন্তু মারিকো তখন কেবল এলিমেন্টারি স্কুলে পড়ে তার কাছে এই প্রতিশ্রুতি, এই বাক্যগুলো ছিল অর্থহীন কখনো যে দ্বিতীয় ট্রান্সপ্ল্যান্ট হতে পারে, সে সম্ভাবনাটুকু তার মাথায় আসেনি সে ঠিক করেছিলো, দ্বিতীয়বার সে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করাবে না তার বাবার জোরাজুরিতেই সে রেজিস্টার করতে রাজি হয়েছিল

তার বাবা অবশ্য ডাক্তারের কথায় কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, “কতদিন লাগতে পারে?”

সেটা ঠিক করে তো বলতে পারছি না বড় বড় মেট্রোপলিটান শহরগুলোর হাসপাতালগুলোতে প্রতিবছর প্রায় দশের অধিক ট্রান্সপ্ল্যান্ট সম্পন্ন হয়ে থাকে তার কারণ, টোকিওর মত শহরগুলোতে ডোনারের সংখ্যা প্রচুর যেখানে আমাদের হাসপাতালে আমরা গোটা বছরে একটা কি দুটা ট্রান্সপ্ল্যান্ট করি আবার সমাজের কিছু লোক আছে, যারা ব্রেন ডেড রোগিদের থেকে কিডনি নেয়াটা মেনে নিতে পারেনা অন্তত জাপানে ব্যাপারটা এরকম তাই আমরা বাধ্য হয়ে হার্ট ফেইলিওর মৃত রোগিদের থেকে কিডনি নেবার জন্য অপেক্ষা করি একেবারে সদ্যমৃত রোগীদের থেকেই নেয়ার চেষ্টা করি আমরা, কিন্তু আজকাল অনেক বাঁধা পেরিয়ে সেটা হাতে পাই আমরা তাই সংখ্যাটা অনেক কমে যায় কিডনিটা ম্যাচ করবে কিনা, সেটাও হিসেবে থাকে একটা ওয়েটিং লিস্ট থাকে, যাতে সবকিছু বিবেচনা করে যোগ্য রোগিদেরকেই আমরা বেছে নিই যদি অন্য বিভাগেও একটা ম্যাচড কিডনি পাওয়া যায়, তাহলে আমরা সেটা সেখান থেকেও শিপিং করেও আনতে পারব তা সত্ত্বেওপাচ-দশ বছর অপেক্ষা করাটাও খুব অস্বাভাবিক নয় এক্ষেত্রে

দশ বছর…”

মারিকোর বাবার সেই অসহায় মুখভঙ্গিটা মারিকোর আজো মনে আছে

যদি আজকেই করা যেত অপারেশনটা… …”

ইয়োশিজুমির তিক্ত মেশানো কথাটা আজো তার কানে বাজে

মারিকো তার কথার প্রত্যুত্তরে কিছুই না বলে ঠোঁটটা কামড়ে মেঝেতে তাকিয়ে ছিল

তার মনে হচ্ছিল, সবাই তাকে দোষি ভাবছে তারা ভাবছে, অপারেশনটা সফল হয়নি কারণ সে তাদের কথা মন দিয়ে শুনেনি সবাই তার সাথে ভাল ব্যবহার করার ভান করছিলো, কিন্তু ভেতরে তারা তাকে ঘৃণা করছে ব্যাপারটায় তার কোনো সন্দেহ নেই

এর মধ্যে তুমি কি অসুস্থ হয়েছ? সর্দিজ্বর, কাশিএমনকিছু?” ফোনের অপরপাশে থাকা মহিলাটা তাকে জিজ্ঞেস করে তাকে বাস্তবের জগতে হ্যাঁচকা টানে ফিরিয়ে আনলো মারিকো চাঁছাছোলা ভাবে উত্তর দিল, না, তার কিছুই হয়নি অপর হাতটা দিয়ে সে তার বুকে চাপ দিয়ে ধরল বুকের ভেতর হৃৎপিন্ডটা পাগলের মত লাফাচ্ছে, সেটাকে থামাতেই পারছে না সেসত্যিই কি সে আরেকটা ট্রান্সপ্ল্যান্টের সুযোগ পাবে? এবার আগের মত তার বাবার কিডনি হবে না, বরং কোনো অচেনা মৃত মানুষের দেহ থেকে সেটা আসবে চিন্তাটা তার মাথায় আসতেই মনে হল, পানিতে ফেলে দেয়া পাথরের মত সে ডুবে যাচ্ছে

তার কল্পনায় মনে পড়ে স্কুলের বিজ্ঞান ক্লাসের এক্সপেরিমেন্টের কথা সেখানে তাকে একটা মাছ কাটতে হয়েছিল আরেকবার রাস্তায় গাড়ির নিচে চাপা পড়া বিড়ালের মৃতদেহটার কথাও তার চোখের সামনে যেন ভেসে উঠল একটা মৃত মানুষের দেহ থেকে নেয়া একটা অঙ্গ ঠিক করে বললে একটালাশএর কিডনি নিয়ে তার শরীরে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হবে একটা অদ্ভুত শীতলতায় তার শরীরটা ঠান্ডা হয়ে গেল

এটা কোনোমতেই মেনে নেয়া যায় না। আমি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করাবো না

মারিকোর তিক্ত চিন্তাভাবনাগুলো বুঝতে না পেড়ে ফোনের অপর পাশ থেকে ওদাগিরি তাকে তার স্বভাবসুলভ দ্রুতগতিতে জিজ্ঞেস করলো,

তুমি কি জানো, তোমার বাবা কখন আসবে?”

-আসলে বাবা একটু দেরি করেই বাসায় আসেন, তাই… …”

আচ্ছা, বাসায় আসলেই আমাকে সাথে সাথে ফোন করতে বলবে যদি পারো, এক্ষুনি তাকে ফোন করে জানাও তাকে জিজ্ঞেস করো, অপারেশনটা তোমরা করাতে রাজি কিনা যদি খুব শিগগিরই আমাদের জানাতে না পারো, তবে আমরা ওয়েটিং লিস্টের অন্য কাউকে বেছে নেব তাই যত তাড়াতাড়ি পারো সিদ্ধান্তটা আমাদের জানাও




শিগেনরি আনজাই সাহেবের বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় সোয়া এগারোটা বেজে গেল তাদের সেকশন পরবর্তী বছরের ওয়ার্ড প্রসেসর মডেলগুলো ছাড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তাই কয়েক সপ্তাহ ধরেই তাকে প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যে থাকতে হচ্ছে এমনকি ছুটির দিনগুলোতেও ফুসরত পাচ্ছেন না কাজের মধ্যে ডুবে থাকার এই বাজে অভ্যাসটাতে তিনি অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন আগে এরকম কথা তিনি ভাবতেও পারতেন না

ক্লান্ত শরীরে তিনি সদর দরজা খুললেন তিনি লক্ষ্য করলেন, হলরুমের বাতিটা নেভানো কৌতূহলী হয়ে তিনি বাতিটা জ্বালালেন মেঝেতে মারিকোর জুতো জোড়া পরিপাটি করে রাখা, তারমানে সে বাড়িতেই রয়েছে অন্য সময় তো সে তার জন্য হলরুমের বাতিটা জ্বালিয়েই রাখে

গলার টাই ল্যুজ* করে তিনি কিচেনে গেলেন ফ্রিজ খুলে একটা ঠান্ডা হ্যাম আর এক ক্যান বিয়ার বের করে নিলেন হ্যামটা মুখে কামড়ে ধরে খালি হাতটা দিয়ে তিনি লিভিংরুমের দরজাটা খুললেন মেঝেতে বসে টিভিটা চালু করে দিলেন দক্ষিণ আমেরিকাতে একটা প্লেন ক্র্যাশ করেছে, সেটা নিয়েই আলোচনা হচ্ছে টিভিতে

দুর্ঘটনার ছবিগুলো দেখতে দেখতে তার মনে হল, কদিন ধরে তার কন্যার সাথে তার খুবই কম দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছে সে এখনো বোধহয় জেগে আছে কিন্ত না, এখন আর আগের মত তার রুমে গিয়ে তার সাথে কথা বলা যায় না আর সকালবেলাতে দুজনেই খুব ব্যস্ত থাকেন, তাই কথাবার্তা বলার সময়টুকু হয়না আলাদা আলাদা সময়ে খাবার খেতে খেতে ব্যাপারটা খুব সাধারন হয়ে দাঁড়িয়েছে হয়ত মারিকো কলেজ যাওয়ার আগ পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকবে আনজাই সাহেব ঢকঢক করে গিলে বিয়ারের ক্যানটা খালি করে দিলেন

বিশ মিনিট পর প্লেন ক্র্যাশ নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদনটা শেষ হল এখন তাকে দুয়েকটা ফাইলে চোখ বুলাতে হবে, তাই টিভিটা বন্ধ করে দিলেন আড়মোড়া ভেঙ্গে শরীর থেকে আলস্য দূর করার চেষ্টা করলেন

বাবা

মারিকো পেছন থেকে তার বাবাকে ডাক দিলো

আনজাই সাহেব মাথা ঘুরিয়ে দেখলেন, তার মেয়ে পায়জামা পরে তার দিকে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে তার চোখটা কেমন জানি ফোলা ফোলা দেখাচ্ছে

কি হয়েছে মা? কোনো সমস্যা?”

মারিকো কথাটার উত্তর না দিয়ে বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো তার মুখে এরকম গম্ভীর ভাবভঙ্গি দেখে তিনি মনে মনে কিছুটা বিরক্তবোধ করলেন

খাওয়া-দাওয়া হয়েছে তো?” তিনি জিজ্ঞেস করলেননাকি আবার খিদে পেয়েছে? এত রাতে কিন্তু কিছু খাওয়া ঠিক হবেনা

“… একটু আগে একটা ফোন এসেছিলো…”

তার গলার আওয়াজে অস্থিরতা টের পেয়ে আনজাই সাহেব বিয়ারের ক্যানটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ালেন

ফোন এসেছিল? হাসপাতাল থেকে? ডাক্তার করেছিলো?”

নাকি জানিট্রান্সপ্ল্যান্ট কোটাইপ একজন ফোন দিয়েছিল

ট্রান্সপ্ল্যান্ট শুনে আনজাই সাহেব স্থির হয়ে গেলেন

তারা আবার কি চায়? তারা কি কি বলেছিল মনে আছে? কখন ফোন কখন দিয়েছিল?”

আটটার দিকে

তাহলে আমাকে আগে জানাওনি কেন?”

আনজাই ফোনের কাছে দৌড়ে গেলেন মেয়ের কাছ থেকে নাম্বারটা নিয়ে তিনি ডায়াল করলেন অবশেষে তাদের সুযোগ কি এলো? সেটা বাদে ফোন দেয়ার আর কোনো ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়তাহলে’… তিনি ভাবলেন, ‘মারিকো কেন তাকে কথাটা বলতে দ্বিধাবোধ করছে?’

শীঘ্রই ফোনটার অপর পাশ থেকে গলার আওয়াজ ভেসে এল

আপনারা কি ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য রাজি?”

অবশ্যই অবশ্যই!” আনজাই সাহেব উৎসাহে ফেটে পড়লেন কো-অর্ডিনেটর তখন তাকে বিস্তারিত ব্যাপার স্যাপার সংক্ষেপে বলতে শুরু করলেন সবার প্রথমে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মারিকোকে হাসপাতালে আসতে হবে সেখানে তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সব ঠিকঠাক থাকলে ডোনারের হার্ট বন্ধ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে

তার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আনজাই সাহেব ফোনটা রাখলেন

মারিকো, তুমি অতি শীঘ্রই ট্রান্সপ্ল্যান্ট পেতে যাচ্ছ! ভাবতেও পারিনি এত দ্রুত সুযোগ পেয়ে যাব তুমি আবার সুস্বাদু খাবার খেতে পারবে!”

তিনি মারিকোর দিকে হাসিমুখে তাকালেন অদ্ভুত ব্যাপার, তার মেয়ের মুখ শুকিয়ে গেছে পাংশুমুখে দাঁড়িয়ে থেকে অল্প অল্প কাঁপছে সে আনজাই উল্লাসটা চেপে রেখে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন

কি হয়েছে মারিকো? ডাক্তাররা তোমার সকল সমস্যার সমাধান করে দেবেন তুমি খুশি নও?”

“…নাতার মেয়ে ক্লান্তসুরে বলল

এরকম কেন করছে সে?

তোমার আজ কি হয়েছে বলো তো? সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে প্রথমবার তো তুমি অনেক খুশি ছিলে, মনে নেই?”  
মারিকো তার বাবার হাতটা ঝাকি মেরে সরিয়ে দিল
না! আমি কোনো ট্রান্সপ্ল্যান্ট চাইনা!”

আনজাই তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু মারিকো তাকে সুযোগ দিলোনা সে পিছিয়ে গেল আচমকা এরকম ভাল সংবাদ পেয়ে সে হয়তো বিভ্রান্তিতে পড়ে গিয়েছে কীভাবে যে তাকে শান্ত করা যাবে, তা আনজাই সাহেবের জানা ছিল না

মারিকো

হাঁটু কাঁপতে থাকা অবস্থাতেই সে দেয়ালের দিকে পিঠ লাগিয়ে চিৎকার করলো, “আমি ফ্রাংকেস্টাইনের রাক্ষস নই! আমি রাক্ষস হতে চাই না!”





No comments:

Post a Comment

আরো যা দেখতে পারেন