Wednesday 24 April 2019

A Monster Calls-1



অন্যান্য দানবদের মত মধ্যরাতের ঠিক পরেই সে উপস্থিত হল

কনর তখন জেগে ছিল

দুঃস্বপ্ন দেখছিলো সে সাধারন কোনো দুঃস্বপ্ন না, সেই একই দুঃস্বপ্ন। কদিন ধরেই সে সেটা দেখছে। সেই একই অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ, প্রচন্ড বাতাসের মধ্যে চিৎকারের শব্দ। শক্ত করে কারো হাত ধরে রাখার চেষ্টা করেও সেটা ফসকে যাচ্ছে। দুঃস্বপ্নের শেষটা.........

“ দূর হও! ”, বিড়বিড় করে কনর তার বেডরুমের অন্ধকারে বলে উঠল । অন্ধকারটা দূর হলেই যেন দুঃস্বপ্ন বন্ধ হয়ে যাবে। দুঃস্বপ্নটা যেন জেগে ওঠার সময় তাকে অনুসরণ না করে। “ দূর হও এক্ষুনি। 

চোখ খুলে সে পাশের টেবিলে রাখা এলার্ম ঘড়িটার দিকে তাকালো। তার মা টেবিলের পাশে সেটা রেখে গিয়েছেন। ঘড়িতে তখন ১২.০৭ জ্বলজ্বল করছে। মধ্যরাতের পর কেবল সাত মিনিট পার হয়েছে। পরের দিন সকালে স্কুল থাকুক কিংবা পরের দিন রবিবার হোক, দেরি হয়ে গিয়েছে।

দুঃস্বপ্নের কথাটা সে কাউকে বলেনি । মা কে বলার প্রশ্নই আসে না। মাঝেমধ্যে ফোন করে খোঁজখবর নেয়া বাবা,স্কুলের বন্ধুবান্ধব এমনকি তার দাদীকেও সে এ ব্যাপারে জানায়নি। কোনোমতেই তাদের বলা যাবেনা।
দুঃস্বপ্নে যা ঘটছে, তা কারো জানার প্রয়োজন নেই।

কনর চোখ পিটপিট করে তাকালো তার রুমের চারদিকে,ভ্রু কুঁচকে গেল তার। কিছু একটা বেখাপ্পা লাগছে তার। সে বিছানায় উঠে বসল, ঘুমঘুম ভাবটা আরো দূর হল তার। দুঃস্বপ্ন তাকে ততক্ষনে ছেড়ে গিয়েছে, কিন্তু কিছু একটা তার কাছে খুবই অদ্ভুত লাগছে জিনিসটা যে কী, সেটা ঠিক ধরতে পারছে না......

নিঃশব্দের মধ্যে সে চুপচাপ থেকে শোনার চেষ্টা করলো, কিন্তু নীচতলার ঘড়ির টিকটিক শব্দ, পাশের রুম থেকে মায়ের ঘুমের মধ্যে নড়াচড়ার শব্দ বাদে আর কিছুই কানে এল না তার।

কিছুই না।

হঠাৎ করে একটা শব্দ তার কানে প্রবেশ করলো। অবশেষে সে বুঝতে পারল, কি কারনে তার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে।

কে জানি তাকে দূর থেকে ডাকছে।

কনর।

ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠল তার, পেটের মধ্যে নাড়ি পাঁক দিয়ে উঠল। দুঃস্বপ্ন থেকে কি ওটা তাকে অনুসরণ করে বেরিয়ে এসেছে?

“ বোকার মত ভেব না। ” সে নিজেই নিজেকে বোঝাল। “ এখন আমার রাক্ষস খোক্ষসে বিশ্বাস করার বয়স নেই।”

কথাটা ঠিক ছিল। গতমাসেই সে তেরোতে পা দিয়েছে। এইসব কাল্পনিক দানব, রাক্ষস কে বাচ্চারাই কেবল ভয় পায়। ভয় পেয়ে বিছানা ভিজিয়ে ফেলে। কেবলমাত্র.........

কনর।

আবার সে শুনতে পেল। কনর ঢোক গিলল। অক্টোবর হওয়া সত্বেও প্রচন্ড গরম পড়েছিল, ফলে জানালা ছিল খোলা। বোধহয় বাতাসের ফলে পর্দায় ঘসা লেগে এরকম শব্দ তৈরি হচ্ছিল.........

কনর

আচ্ছা, ঠিক আছে, ওটা বাতাসের কারনে হচ্ছে না। কেউ আসলেই তার নাম ধরে ডাকছে। কিন্তু গলাটা তার পরিচিত না। অন্তত তার মায়ের নয়, এটা একেবারে নিশ্চিত। কোনো মহিলার গলা নয় ওটা । হয়ত তার বাবা আমেরিকা থেকে হুট করে চলে এসেছেন তাকে সারপ্রাইজ দিতে। এত রাতে ফোন না দিয়ে বাইরে থেকে ডাকছেন, এক মুহূর্তের জন্য হলেও মাথায় এল চিন্তাটা । নাহ, সেটা অসম্ভব।  

কনর।

না, তার বাবার গলাও নয় সেটি । গলার স্বরটা কেমন জানি রাক্ষুসে ধরনের।

এমন সময় সে বাইরের কাঠের পাটাতনের ওপর পা ফেলার শব্দ শুনতে পেল। এরকম শব্দ কেবল কোনো বিশাল প্রাণির পক্ষেই করা সম্ভব।

সে জানালার সামনে গিয়ে দেখতে চাচ্ছিল না কে শব্দ করছে। কিন্তু একই সাথে মনের ভেতর থেকে কেউ তাকে উৎসাহ দিচ্ছে সেটা দেখে আসার জন্য।

ততক্ষনে ঘুম পুরোপুরি কেটে গিয়েছে। গায়ের ওপর থেকে চাদরটা সরিয়ে সে বিছানা থেকে নামল। ধীরে ধীরে সে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো । বাইরে চাঁদের আধো আধো ধূসর আলোর মধ্যে সে বাড়ির পেছনের ছোট্ট টিলা টা দেখতে পাচ্ছিল। টিলাটার ওপরে তাদের এলাকার চার্চটা অবস্থিত, পাশে রেললাইন চলে গিয়েছে। রেললাইনের দুটি ধাতব স্টিলের লাইন চাঁদের আলোয় ঝকমক করছিল। চাঁদ কিন্তু উদারভাবে চার্চের সাথে লাগোয়া গোরস্থানেও আলো বর্ষন করছিল। পুরোনো কবরে গোরস্থানটা ভরা, এমন সব কবরও সেখানে আছে, যার নাম-ধাম সব মুছে গিয়েছে।

গোরস্থানের মধ্যে গজিয়ে ওঠা বিশাল ইউ গাছটাও কনর স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিল। গাছটা এতটাই প্রাচীন যে,মনে হয় চার্চের পাথর দিয়েই গাছটা বানানো হয়েছে। সুবিশাল গাছটার নাম যে ‘ইউ’ গাছ, কয়েকবছর আগে তার মা শিখিয়ে দিয়েছিল। ছোটবেলায় সেটার ফল খেতে মা নিষেধ করেছিলেন, কারন সেগুলো নাকি বিষাক্ত। গতবছর রান্নাঘরে কাজ করতে করতে তার মা জানালা দিয়ে সেটা দেখিয়ে বলেছিলেন, “ ঐ যে, বিশাল গাছটা, ওটা একটা ‘ ইউ  ’ গাছ। ”

আবার সে শুনতে পেল, কেউ তাকে ডাকছে।

কনর

যেন দুই কানেই কেউ ফিসফিস করে বলছে।

“ কী!? ” সহ্য করতে না পেরে সে চিৎকার করে উঠল। বুকের ভেতর হৃৎপিন্ড একেবারে পাগলের মত নাচানাচি করছে। যা হয় হবে।

একগুচ্ছ মেঘ এসে চাঁদটাকে ঢেকে দিল। পুরো এলাকাটা যেন মেঘের চাদরে ঢেকে গেল। হুশ শব্দ করে বাতাসের প্রবাহ টিলা বেয়ে তার জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো। ফলে পর্দাগুলো পতপত করে উড়তে শুরু করলো । কাঠের ওপর হেঁটে যাওয়ার আওয়াজ সে আবার শুনতে পেল। শব্দটা কোনো জীবন্ত, ক্ষুধার্ত প্রানীর পেটের গরগর করা শব্দের মত। যেন কেউ খাবার খুঁজে বেরাচ্ছে ক্ষুধা মেটানোর জন্য।

মেঘ সরে যেতেই চাঁদের আলোয় আবার সবকিছু আলোকিত হয়ে গেল।

কনর দেখতে পেল, ইউ গাছটা এখন তাদের পেছনের বাগানে কীভাবে যেন উদয় হয়েছে।

আর সেটাই ছিল দানবটা।

কনর তাকিয়ে দেখল, গাছটার ওপরের শাখা প্রশাখা একত্রিত হয়ে একটা ভয়ংকর মুখের মত চেহারাতে রূপ নিল। সেখানে মুখ ছিল, নাক ছিল, এমনকি দুটো জ্বলজ্বলে চোখও ছিল। একটু নিচের শাখাপ্রশাখা গুলো মোচড়াতে মোচড়াতে একসময় দুটি বিশাল হাতে পরিণত হল। নিচে মূলের পাশেই একটা পা গঠিত হয়ে গেল। বাকি গাছটুকুর কান্ড একে একে শিরদাঁড়া, ধড়ে পরিণত হল। সরু সুইয়ের মত পাতাগুলো সারা শরীর চামড়ার মত ঢেকে দিল। পাতাগুলো এমনভাবে নড়াচড়া করছিল, যেন পাতার নিচে মাংসপেশি আর ফুসফুস রয়েছে। মনে হচ্ছিল, শ্বাস নেয়ার ফলে পাতা ওঠানামা করছে। 



উচ্চতায় কনরের জানালা অব্দি দানবটা পৌঁছে গিয়েছে । সব প্রয়োজনীয় অঙ্গ গঠিত হয়ে যাবার পর নিজের প্রস্থটা বাড়াতে শুরু করলো দানবটা। দেখে তাকে খুব শক্তিশালি, না, তাকে দানবীয় দেখাতে লাগল। পুরোটা সময় সে কনরের দিকে তাকিয়ে ছিল। কনর দানবটার মুখ থেকে গমগম স্বরে শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল। দানবটা এবার তার বিশাল হাত দুটো কনরের জানালার ওপর রাখল, মুখ জানালা বরাবর রাখল। চাপ দিয়ে রাখায় কনরের বাড়িটা হালকা শব্দ করে প্রতিবাদ জানালো।

তখন দানবটা কথা বলে উঠল।

“ কনর ও’ম্যালে । ” দানবটা কম্পোস্ট সারের মত সোঁদা গন্ধের তীব্র স্রোত পুরো রুমে ছড়িয়ে দিয়ে বলে উঠল। বাতাসের তীব্র স্রোতে কনরের চুল উঠে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। গলার স্বর নিচু হলেও ভরাট ছিল, শব্দের কম্পন যেন বুকের ভেতর কাঁপন ধরিয়ে ছাড়ছিল।

“ আমি তোমাকে নিতে এসেছি, কনর ও’ম্যালে। ” দানবটা বলল। জানালার ওপর চাপ দিতেই পুরো বাড়িটা কেঁপে উঠল। কনরের রুমের টাঙ্গানো ছবিগুলো, শেলফ থেকে বইপত্র, তার পুরোনো খেলনা গন্ডার সব মাটিতে পড়ে গেল।

একটা দানব। কনর ভাবল। একটা সত্যিকারের দানব। তাও আবার চোখের সামনে । স্বপ্নে নয়, বরং তার জানালার পাশেই সেটা দাঁড়িয়ে আছে।

সে তাকে নিতে এসেছে।

কিন্তু কনর পালালো না।

বরং সে লক্ষ্য করলো, তার মধ্যে কোনো ভয়ডর কাজ করছে না।

তার মনে একটা অনুভূতিই কাজ করলো, আর সেটা হল হতাশা। কারন, মনে মনে দানব বলতে যা সে ভেবে নিয়েছিল, তার সাথে আসল দানবের কোনো মিলই নেই।  

“ তাহলে ভেতরে এসে আমাকে নিয়ে যাও ” সে বলল।






চারদিক নিঃস্তব্দ হয়ে গেল কিছুক্ষনের জন্য।

“ কী বললে তুমি? ” দানবটা জিজ্ঞেস করলো।

“ আমি বলেছি, আমাকে এসে নিয়ে যাও। ” হাত দুটো ক্রসের মত রেখে উত্তর দিল কনর।

দানব কিছুক্ষনের জন্য থেমে গেল। এরপর বিকট স্বরে চিৎকার দিয়ে দুই হাত মুঠি করে বাসার ছাদে ঘুষি মারল। কনরের রুমের ছাদ কেঁপে উঠল তাতে, দেয়ালের এদিকে সেদিকে ফাটল দেখা দিল। বজ্রপাতের মত চিৎকার আর বাতাসের তীব্র স্রোতে রুমটা নড়ে উঠল।

“ যত ইচ্ছে তত চিৎকার করো। ” কনর এর মুখে কোনো বিকার নেই। আগের মত গলাতেই সে বলল, “ এর থেকে খারাপ ঘটনা আমি দেখেছি। ”

কথাটা শুনে দানবটার যেন রাগ আরো বেড়ে গেল। জানালার কাঁচ, ইটপাথর ভেঙ্গে কনরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে। বিশাল, কুৎসিত এক হাত দিয়ে কনরকে মেঝে থেকে তুলে নিলো দানবটা। ঘর থেকে কনরকে বাইরে নিয়ে আসলো সে। হাতটা সে এত শক্ত করে মুষ্ঠি করে রেখেছে যে, কনরের বুকে ব্যাথা লাগছিল। কনর তখন দানবের করাতের মত দাঁত সামনাসামনি দেখতে পেল। দানবের মুখ থেকে এক স্রোত গরম বাতাস তাকে ধাক্কা দিল।

একটু পরেই দানবটা থেমে গেল।

“ তুমি সত্যিই ভয় পাচ্ছনা ? ”

“ না, একেবারেই না। ” কনর সাফসাফ জবাব দিল। “ তোমাকে অন্তত ভয় পাচ্ছিনা। ”

দানবটার যেন ভ্রু কুঁচকে গেল।

“ ভয় তুমি পাবেই। ” সে ঘোষনা করলো। “ একেবারে শেষের দিকে তুমি অবশ্যই ভয় পাবে।  ”


কনর দেখে, দানবটা তাকে গিলে খাওয়ার জন্য তার বিশাল মুখটা হাঁ করেছে । এরপর আর মনে নেই। 


No comments:

Post a Comment

আরো যা দেখতে পারেন