Monday 23 March 2020

দ্য ইমরটাল লাইফ অব হেনরিয়েটা ল্যাকস by রেবেকা স্ক্লুট










দ্য ইমরটাল লাইফ অব হেনরিয়েটা ল্যাকস
রেবেকা স্ক্লুট









                                                                                                                                                                          ভূমিকা
                                                                                                                     ফটোগ্রাফের সেই নারী


বেশ অনেকদিন ধরেই আমার দেয়ালে অচেনা একটা নারীর ছবি টাঙ্গানো রয়েছে ছবিটার বাম কোণাটা ছিঁড়ে গিয়েছিল, সেটাকে টেপ দিয়ে জোড়া লাগানো হয়েছে ছবির নারী কোমড়ে হাত রেখে, ঠোঁটে গাঢ় লাল রঙের লিপস্টিক দিয়ে, চমৎকার একটা ড্রেস পরে ক্যামেরার দিকে সরাসরি তাকিয়ে হাসছেন ছবির সময়কাল ১৯৪০ এর দিকে। ছবির নারীটির বয়স তখন তিরিশের ঘরেও পৌঁছায়নি তার হালকা বাদামি রঙের চামড়া ছিল মসৃণ, হাসিমাখা চোখদুটোতে ছিল চিরসজীবতা সেই চোখদুটো হয়ত জানত না, তার ভেতরে এক টিউমার জন্ম নিয়েছে; যে টিউমারটা তার পাঁচ সন্তানকে মা হারা করবে, একই সাথে মেডিসিন জগতে এক নতুন দ্বারপ্রান্তের সূচনা করবে ছবির নিচের ক্যাপশনে লেখা রয়েছে- “হেনরিয়েটা ল্যাকস, হেলেন লেইন অথবা হেলেন লারসন

ছবিটা কে তুলেছিল, তা কারো জানা নেই কিন্তু ছবিটা শতশত বার ম্যাগাজিনে, বিজ্ঞানভিত্তিক বইয়ে ছাপানো হয়েছেব্লগে এমনকি আজকাল ল্যাবরেটরির দেয়ালেও শোভা পায় এই ছবিটা সাধারনত তাকে হেলেন লেইন বলেই পরিচয় দেয়া হয়, কিন্তু অনেক সময় তার ভাগ্যে সেটাও জুটে না তাকে কেবল হেলা (HeLa) বলেই ডাকা হয় পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বপ্রথম অমর মনুষ্য কোষ এর কোডনেম হচ্ছে এই হেলা কোষগুলো ছিল তারই; তার মৃত্যুর কয়েক মাস পূর্বে তার জরায়ুপথ থেকে সেই কোষগুলো কেটে নেয়া হয়েছিল  

তার আসল নাম ছিল হেনরিয়েটা ল্যাকস  

বছরের পর বছর আমি সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে পার করেছি কল্পনা করার চেষ্টা করেছি, তিনি কিরকম জীবন কাটিয়েছিলেন, তার সন্তানদের ভাগ্যে কী ঘটেছিলতার জরায়ুমুখ থেকে কেটে নেয়া সেই কোষগুলোর কথা যদি তিনি জানতেন, তবে কী ভাবতেন তাও ভেবে দেখার চেষ্টা করেছি( সেই কোষগুলো কেটে নেবার পর সেটা বিক্রি হয়েছে, কেনা হয়েছে, প্যাকেজ করে গোটা পৃথিবীর কোটিসংখ্যক ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে)জিরো গ্রাভিটিতে মনুষ্য কোষ এর কী হয় তা দেখার জন্য তার কোষগুলো প্রথম স্পেস মিশনেও নেয়া হয়েছিলকিংবা তার কোষ যে মেডিসিন জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন সমস্যাগুলো সমাধানে সহায়তা করেছিলো : পোলিওর ভ্যাকসিন তৈরিতে, কেমোথেরাপি, ক্লোনিং, জিন ম্যাপিং, ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনব্যাপারগুলো জানতে পারলে তার মনের কী অবস্থা হত, সেটাও কল্পনা করার চেষ্টা করেছিতবে আমি ব্যাপারে নিশ্চিত, তিনি যদি জানতেন আজকাল ল্যাবরেটরিগুলোতে তার যে পরিমাণ কোষ নিয়ে গবেষনা করা হচ্ছে, তার সংখ্যা তার দেহের কোষের সংখ্যার থেকেও বেশি-তিনি আমাদের মতই প্রচন্ড অবাক হতেন

আজ হেনরিয়েটা এর কোষগুলোর কতগুলো জীবিত আছে, তার সঠিক সংখ্যাটা বের করা সম্ভব নয়এক বিজ্ঞানী অবশ্য একটা আন্দাজ করার সাহস করেছিলেনতার মতে, এখন পর্যন্ত পেটরি ডিশে জন্মানো হেলা কোষগুলোকে যদি দাড়িপাল্লায় মাপার চেষ্টা করা হয়, তবে তার ওজন দাঁড়াবে ৫০ কোটি মেট্রিক টনঅস্বাভাবিক একটা সংখ্যা, কারণ চিন্তা করে দেখুন, কোষের কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে কোনো ওজনই নেইআরেক বিজ্ঞানী হিসাব করে বের করেছেন, যদি কোষগুলোকে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সারি সারি করে রাখা হয়, তবে সেটা গোটা পৃথিবীকে তিনবার ঘুরে আসতে পারবেসেটার দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে প্রায় ৩৫০ কোটি ফিটের চেয়েও বেশিঅথচ হেনরিয়েটা নিজে কেবল পাঁচ ফিটের একটু বেশি লম্বা ছিলেন

হেলা কোষের ব্যাপারে তার পেছনের নারীর ব্যাপারে আমি প্রথম জানতে পারি ১৯৮৮ সালে, তার মৃত্যুর প্রায় ৩৭ বছর পরসেসময় আমার বয়স ছিল কেবল ১৬কমিউনিটি কলেজের বায়োলজি ক্লাসে বসে ডোনাল্ড ডেফলার, মানে আমার শিক্ষকের মুখে প্রথম ব্যাপারে শুনেছিলামছোটোখাটো, টাক মাথার মানুষ ছিলেন তিনিলেকচার শুরু করার জন্য একটা বড়সড় প্রজেক্টর এর সুইচ টিপে দিলেন তিনিতার পেছনের দেয়ালে যে দুটা ডায়াগ্রাম আবির্ভূত হয়েছিল, সেগুলোর দিকে তিনি আঙ্গুল দিয়ে দেখালেনডায়াগ্রামটা ছিল কোষের বংশবিস্তারের প্রক্রিয়া নিয়েকিন্তু প্রথম দেখায় আমার কাছে মনে হয়েছিল সেটা কেবল নিয়ন রঙের কতগুলো অর্থহীন আঁকিবুঁকি; কোনোটা সারি, কোনোটা কলাম আকারে সাজানো, কোনোটা বৃত্তাকৃতির, আর কতগুলো অর্থহীন কথাবার্তা সেখানে লেখাযেমন, “এমপিএফ(MPF) ট্রিগার হওয়ার ফলে প্রোটিন একটিভেশন এর চেইন রিএকশান শুরু হয়

নিয়মিত ক্লাস না করার কারনে আমি একটা পাব্লিক হাইস্কুলের ফ্রেশম্যান ইয়ারে পাশই করতে পারিনিতাই অন্য একটা হাইস্কুলে ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছিলামতবে সেটাতে সমস্যা ছিল একটাতারা বায়োলজির পরিবর্তে ড্রিম স্টাডিজ পড়াবেতাই ক্রেডিটের জন্য আমি ডেফলারের ক্লাস করছিলাম কারনেই মাত্র ১৬ বছর হওয়া সত্ত্বেও আমাকে একটা কলেজের লেকচার হলে বসে থাকতে হচ্ছিল, যেখানে একটু পরপরমাইটোসিসআরকাইনিস ইনহিবেটরএর মত ভারি ভারি শব্দ শোনা লাগছেব্যাপারটাতে আমি সম্পূর্ন বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম

পেছন থেকে একজন ছাত্র চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলো, “এই ডায়াগ্রামের সবকিছু কী আমাদের মুখস্ত থাকা লাগবে?”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো ডেফলারহ্যাঁ, সবই মুখস্ত থাকা লাগবেএমনকি এগুলো পরীক্ষাতেও আসবেকিন্তু আপাতত তার উদ্দেশ্য সেটা নয়তিনি আমাদের বোঝাতে চাচ্ছিলেনকোষজিনিসটা কতটা অসাধারন! আমাদের শরীরে প্রায় কয়েকশ ট্রিলিয়নের মত কোষ রয়েছেপ্রত্যেকটা কোষ আকারে এতটাই ক্ষুদ্র যে, একটা ফুলস্টপের মধ্যে অন্তত কয়েক হাজার কোষ সহজে এঁটে যাবেআমাদের দেশের সকল টিস্যু কোষ দিয়ে তৈরিআমাদের মাংসপেশি, হাড়, রক্ত-মানে যা যা দিয়ে আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরি, তার সবই কোষের অবদান

একটা মাইক্রোস্কোপের নিচে কোষকে দেখলে মনে হবে যেন একটা ভাঁজা ডিম দেখছোডিমের সাদা অংশটা হচ্ছে সাইটোপ্লাজমসাইটোপ্লাজম পানি আর প্রোটিন দিয়ে ভর্তি, যা দিয়ে নিজের খাবারদাবারের চাহিদা পূরন করেতাতে কুসুমের মত রয়েছে নিউক্লিয়াসতোমার যে নিজস্বতা, যে স্বকীয়তা তার সকল তথ্য, মানে জেনেটিক সকল তথ্য থাকে এই নিউক্লিয়াসেনিউইয়র্ক শহরের রাস্তা যেমন সবসময় ব্যস্ত থাকে, ঠিক তেমনি সাইটোপ্লাজম অংশটুকুও সবসময় ব্যস্ত থাকেসাইটোপ্লাজমে বিরতিহীনভাবে নানান ধরনের এনজাইম, শর্করা, পানি, পুষ্টিকর উপাদান আর অক্সিজেন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছেএকই সাথে ক্ষুদ্রাকৃতির সাইটোপ্লাজমিক ফ্যাক্টরিগুলো প্রতিটা মুহূর্ত কাজ করে যাচ্ছে, তৈরি করছে শর্করা, ফ্যাট, প্রোটিন, শক্তিআর সেসব দিয়েই গোটা সাইটোপ্লাজমকে চালু রাখছে, নিউক্লিয়াসকে শক্তির যোগান দিচ্ছেএই যে সকল কর্মকান্ড ঘটছে সাইটোপ্লাজমে, সবই নিয়ন্ত্রনে রাখছে নিউক্লিয়াসতোমার দেহের প্রত্যেকটা কোষের নিউক্লিয়াসের ভেতর রয়েছে তোমার সম্পূর্ন জিনোমের অবিকল একটা কপিএই জিনোমটাই কোষকে বলে দেয় কখন বৃদ্ধি পেতে হবে আর কখন বিভাজিত হতে হবেতারা কাজটা ঠিকমত করছে কিনা, তাও নজরে রাখেসেটা তোমার হার্টবিট নিয়ন্ত্রনে রাখার কাজও হতে পারে, কিংবা তুমি এই পৃষ্ঠার লেখাগুলো পড়ে বুঝতে পারছো কিনা তাও হতে পারে

ডেফলার ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাখ্যা করতে লাগলেন মাইটোসিস, মানে কোষ বিভাজনের একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভ্রূণ ধীরে ধীরে শিশুতে পরিণত হয়আমাদের দেহের কোনো ক্ষতস্থান থাকলে কিংবা আমাদের দেহে কোনো কারনে রক্তস্বল্পতা দেখা দিলে এই মাইটোসিসের মাধ্যমেই সেসব ক্ষতস্থানে নতুন কোষ জন্মাতে শুরু করে, রক্তের ঘাটতিও পূরন করেঅপূর্ব, তাই না?” তিনি উচ্ছ্বসিত গলায় আমাদের জিজ্ঞেস করলেনঅনেকটা কোরিওগ্রাফিক নাচের মতনিখুঁতভাবে সব তাল মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে

কোথাও একটা ছোটোখাটো ভুল দেখা দিলেই কোষের বিভাজন নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়, তিনি আমাদের জানালেনকেবলমাত্র একটা এনজাইমের ভুলের কারনে অথবা একটামাত্র প্রোটিন ভুলবশত একটিভেট হয়ে গেলেই তোমার ক্যান্সার হতে পারেমাইটোসিসে গন্ডগোল এর মাধ্যমেই সেটা সারাশরীরে ছড়িয়ে পড়ে

আর আমরা কীভাবে সেটা জানতে পারলাম জানো? কালচারে ক্যান্সার কোষের ওপর গবেষনা করেডেফলার বললেনমুচকি হেসে তিনি এবার বোর্ডের দিকে ঘুরে গেলেনবোর্ডে বড় করে দুটা শব্দ লিখলেন : হেনরিয়েটা ল্যাকস

হেনরিয়েটা ল্যাকস ১৯৫১ সালে জরায়ুমুখের ক্যান্সারে মারা গিয়েছিলেনকিন্তু তিনি মারা যাওয়ার আগে একজন সার্জন তার টিউমার থেকে কিছু নমুনা নিয়ে পেটরি ডিশে রেখে দিয়েছিলেনযুগের পর যুগ ধরে বিজ্ঞানীরা কালচারে মনুষ্য কোষ বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে আসছিলেনকিন্তু একসময় না একসময় সেগুলো নষ্ট হতইহেনরিয়েটার কোষগুলো অবশ্য ভিন্ন ছিলসেগুলো প্রতি চব্বিশ ঘন্টা পর পর একেক জেনারেশন কোষ তৈরি করত, তাও আবার কোনো বিরতি ছাড়াইল্যাবরেটরিতে জন্মানো প্রথম অমর কোষ ছিল সেগুলো

হিসেব করে দেখলে দেখা যাবে যে, হেনরিয়েটার শরীরে কোষগুলো যতদিন ছিল তার থেকে বেশি সময় তারা বাইরের পৃথিবীতেই কাটিয়ে ফেলেছেডেফলার বললেনআমরা যদি পৃথিবীর যেকোনো সেল কালচার ল্যাব গিয়ে ফ্রিজটা খুলে দেখি তবে দেখতে পাব, মিলিয়ন সংখ্যক ( বিলিয়ন বললেও ভুল হবে না) হেনরিয়েটার কোষ সেখানে ছোট ছোট শিশিতে জমিয়ে রাখা হয়েছে

ক্যান্সার যেসব জিনের কারনে সংঘটিত হয় আর যা দিয়ে সেটা দমন করা যায়- শুরুর দিকে হেনরিয়েটার কোষগুলো সেই গবেষনার কাজেই ব্যবহৃত হতআর সেসব নিয়ে গবেষনা করতে গিয়ে হার্পিস, লিউকিমিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, হিমোফিলিয়া আর পার্কিনসন্স রোগের চিকিৎসার জন্য ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হয়েছেসেগুলো দিয়ে ল্যাকটোজ ডাইজেশন, যৌনবাহিত রোগ, এপেন্ডিসাইটিস, মানুষের আয়ু বৃদ্ধি, মশক জনন পদ্ধতি আর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় কাজ করতে গেলে কোষের ওপর যে বিরূপ প্রভাব দেখা দেয়- তাও বের করা সম্ভব হয়েছেকোষগুলোর ক্রোমোসোম আর প্রোটিন নিয়ে এত নিখুঁতভাবে গবেষনা করা হয়েছে যে, আজকাল বিজ্ঞানীরা সেই কোষের সকল খুঁটিনাটি, সকল বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানেনগিনিপিগ আর ইঁদুরের মত হেনরিয়েটার কোষগুলোও একটা আদর্শ ল্যাবরেটরির উপকরন হয়ে দাঁড়িয়েছে

বিগত শতাব্দীর মধ্যে মেডিসিনের জগতে সবচেয়ে যুগান্তকারী অবদান রেখেছে এইহেলাকোষডেফলার বললেন
তারপর হঠাৎ যেন মনে পড়ে গিয়েছে এমনভাবে তিনি বললেন, “ওহ হ্যাঁ, তিনি একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা ছিলেনবলে নামটা ডাস্টার দিয়ে একবারে মুছে ফেললেনফুঁ দিয়ে চকের গুঁড়া হাত থেকে সরিয়ে ক্লাসের সমাপ্তি ঘোষনা করলেন


সবাই যখন ক্লাস থেকে বের হতে ব্যস্ত, আমি তখন চুপচাপ বসেছিলামআমার মাথায় তখন একটা প্রশ্ন ঘুরতে শুরু করেছে : কেবল এটুকুই? আর কিছু জানা যাবেনা তার ব্যাপারে? নিশ্চয়ই আরো অনেক কাহিনি লুকিয়ে আছে এর ভেতরে

আমি ডেফলারকে অনুসরন করে তার অফিসে ঢুকলাম

হেনরিয়েটা কোথা থেকে এসেছেন?” আমি জিজ্ঞেস করলামতিনি কী জানতেন তার কোষগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ন? তার কী কোনো বাচ্চাকাচ্চা ছিল?”

তোমাকে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারলে আমি বরং খুশিই হতামকিন্তু সত্যি বলতে কী, কেউই জানে না ওর ব্যাপারে


ক্লাস শেষে দৌড়ে বাসায় গেলামবিছানায় শুয়ে আমার জীববিজ্ঞানের পাঠ্য বইটা খুলে সূচিপত্রেসেল কালচারঅধ্যায়টা খুঁজে বের করলামঅধ্যায়ের শুরুতেই খুঁজে পেলাম তার কথা-

       কালচারের ক্ষেত্রে ক্যান্সার কোষ অর্নিদিষ্টকালের জন্য বৃদ্ধি পেতেই থাকেঅনবরত পুষ্টির জোগান থাকলে তারা অনেকটাঅমরহয়ে যায়উৎকৃষ্ট একটা উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ১৯৫১ সাল থেকে ব্যবহৃত একটা নমুনার কথাসেটা সেই ১৯৫১ সাল থেকেই এখনো বেঁচে আছে( এই কোষগুলোকে বলা হয়হেলাকোষকারণ, কোষগুলো নেয়া হয়েছিল হেনরিয়েটা ল্যাকস নামের একজন মহিলার টিউমার থেকে)

কেবল এতটুকুই লেখা আছে তার ব্যাপারেআমার বাবা-মায়ের এনসাইক্লোপিডিয়াতে হেলা কোষ এর ব্যাপারে খুঁজলামনাহ, কোথাও হেনরিয়েটার নাম পর্যন্ত খুঁজে পেলাম না


হাইস্কুল পাশ করার পর কলেজে বায়োলজি ডিগ্রির জন্য পড়াশোনা করার সময় এইহেলাকোষগুলোর কথা সর্বত্র শুনতামহিস্টোলজি, নিউরোলজি, প্যাথোলজিসবক্ষেত্রেই হেলা কোষগুলো ছিল স্বমহিমায় বিরাজমানআমি নিজেও সেই কোষগুলো দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখেছিদেখেছি কীভাবে প্রতিবেশী কোষগুলো একে অপরের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখেকিন্তু ডেফলারের পর আর কাউকে হেনরিয়েটার নাম পর্যন্ত মুখে নিতে দেখিনি। 

নব্বই সালের মাঝামাঝি আমি প্রথম কম্পিউটার হাতে পেলামইন্টারনেট ব্যবহার করে তার ব্যাপারে খোঁজা শুরু করলামকিন্তু তার ব্যাপারে যা যা তথ্য পেলাম সবই ছিলাম বিভ্রান্তিকরঅধিকাংশ ওয়েবসাইটে তার নাম বলা হয়েছে হেলেন লেইনঅনেকগুলোতে বলা হয়েছে তিনি তিরিশ বছর বয়সে মারা গিয়েছেনসাইটগুলোতে চল্লিশ, পঞ্চাশ এমনকি ষাট বছরও লেখা ছিলকয়েকজায়গাতে লেখা ছিল তিনি ওভারিয়ান ক্যান্সারে মারা গিয়েছিলেন, কয়েকটাতে আবার মৃত্যুর কারণ হিসেবে ব্রেস্ট ক্যান্সার কিংবা জরায়ুমুখের ক্যান্সারের কথাও খুঁজে পেলাম

খুঁজতে খুজতে একসময় আমি সত্তর সালের একাধিক ম্যাগাজিনে তার ব্যাপারে লেখা বেশ কয়েকটি আর্টিকেল খুঁজে পেলাম ইবোনি ম্যাগাজিনে হেনরিয়েটার স্বামীর একটা উদ্ধৃতি দেয়া ছিল, “আমার কেবল এতটুকুই মনে আছে যে, হেনরিয়েটার একটা অসুখ ছিলআর সে মারা যাওয়ার পর আমাকে একটা অফিসে ডেকে বলা হয়েছিল তারা ওর শরীর থেকে একটা নমুনা নিতে চানতার জন্য আমার সম্মতি লাগবেকিন্তু আমি মানা করে দিয়েছিলামজেটম্যাগাজিনে বলা হয়েছে, তার পরিবারের সকলেই ব্যাপারটাতে প্রচন্ড ক্ষিপ্র হয়েছিলেনযখন তারা জানতে পেরেছিলেন, হেনরিয়েটার কোষপূর্ন একেকটা শিশি ২৫ ডলার করে বিক্রি হচ্ছে, আর সেই কোষগুলো নিয়ে গবেষনার পর যেসব তথ্য পাওয়া গিয়েছিল, তাও তাদের অনুমতি ছাড়াই নানান আর্টিকেলে প্রকাশিত হচ্ছেতারা প্রচন্ড রেগে গিয়েছিলেন “তাদের অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে এসব করে বিজ্ঞান আর প্রেস সবাই ফায়দা লুটেছে”, ম্যাগাজিনটা তাই বলছে

আর্টিকেলগুলোতে আমি হেনরিয়েটার পরিবারের ছবি খুঁজে পেলাম : তার বড়ছেলে বাল্টিমোরে তার বাসার ডাইনিং টেবিলে বসে আছে, হাতে একটা জেনেটিক্স এর পাঠ্যবইতার মেজ ছেলে একটা মিলিটারি পোশাকে হাস্যরত অবস্থায় একটা বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে আছেকিন্তু একটা ছবি সবগুলো থেকে আলাদা ছিলআর তা ছিল হেনরিয়েটার মেয়ে, ডেবোরাহ ল্যাকস এরছবিটাতে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা উজ্বল চোখে, হাস্যরত অবস্থায়, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছেকেবল ডেবোরাহ ছিল ব্যতিক্রমসে ছবিটায় একাকী ভাবে সবার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলসবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, তাকে দেখে মনে হচ্ছিল কেউ যেন হেনরিয়েটাকেই ছবিটাতে কেটে বসিয়ে দিয়েছেডেবোরাহ ছিল ছাব্বিশ বছর বয়সের সুন্দরী এক তরুণী, ছোট করে রাখা বাদামি রঙের চুল আর বিড়ালাক্ষীর অধিকারিণীছবিটায় সে ক্যামেরার দিকে বেশ কঠোর মুখেই তাকিয়ে ছিলছবিটার ক্যাপশনে লেখা ছিল যে : ছবিটা যখন তোলা হয়েছিল তখন তারা মাত্র কয়েকমাস আগে জানতে পেরেছেন যে হেনরিয়েটার কোষ এখনো জীবিত রয়েছে; অথচ ততদিনে হেনরিয়েটার মৃত্যুর পর ২৫ বছর পেরিয়ে গিয়েছে  
   
মোটামুটি সকল আর্টিকেলে লেখা ছিল, বিজ্ঞানীরা যে আসলে তার কোষ দিয়ে কী গবেষনা করছেন তা ল্যাকস পরিবারের কারো জানা ছিল নাতারা ভেবেছিল, হয়ত সেগুলো থেকে বের করা হচ্ছে তাদের কারো সেই ক্যান্সার আছে কিনাআর্টিকেলে হেনরিয়েটার ছেলে লরেন্স এর প্রশ্ন ছিল এই, ‘তার মায়ের কোষগুলো এখনো বেঁচে আছেতারমানে কী তারাও চিরকাল বেঁচে থাকবে কিনাকিন্তু এসব ঘটনার মধ্যেও কেবল ডেবোরাহ সবসময় চুপ ছিল


গ্র্যাজুয়েশনের জন্য লেখালেখির কাজ শিখতে শিখতে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেছিলাম, একদিন আমি হেনরিয়েটার গল্পটা গোটা পৃথিবীকে শোনাবএমনকি একদিন আমি বাল্টিমোরের ডিরেক্টরি এসিস্ট্যান্স  ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলাম হেনরিয়েটার স্বামী ডেভিড ল্যাকস এর ব্যাপারে জানার জন্যকিন্তু তার কোনো সম্পর্কে কোনো তথ্য সেখানে ছিল নাআমার মাথায় তখন একটাই চিন্তা ঘুরছে : আমি একটা আত্মজীবনী লিখব, যাতে হেনরিয়েটা এবং তার কোষ সম্পর্কে সবকিছু বিশদ করে লেখা থাকবেহেনরিয়েটা যে শুধু একজন সাধারন মানুষ নন, বরং একই সাথে কারো মা, কারো মেয়ে, কারো স্ত্রী- সে দিকটাও তুলে ধরব


তখন অবশ্য বুঝতে পারিনি, কিন্তু সেই ফোন কলটাই ছিল সবকিছুর শুরুএরপরের এক যুগ আমাকে ল্যাবরেটরি থেকে শুরু করে হাসপাতাল, পাগলাগারদেও দৌড়াতে হবেএমন সব মানুষের সাথে পরিচয় হবে যাদের মধ্যে নোবেল বিজয়ী, সবজি বিক্রেতা, দাগী আসামী এমনকি একজন ধান্দাবাজও থাকবে! নিজে সেল কালচার নিয়ে বিশদভাবে জানতে জানার সাথে সাথে গবেষনায় মনুষ্য কোষ ব্যবহারের নৈতিকতার ব্যাপারেও আমি আস্তে আস্তে অভিজ্ঞ হওয়া শুরু করেছিলাম। এ কাজের জন্য আমাকে শারিরীক ও মানসিকভাবে নানান ধাক্কা খেতে হয়েছে। একসময় আমার সাথে ডেবোরাহ এর দেখাও হয়েছে। তার সাথে দেখা করার পর আমি এটা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছি যে, তিনি আমার দেখা সবচাইতে শক্ত ও প্রাণোচ্ছ্বল মানুষদের একজন। আমাদের মধ্যে একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। অবাক হলেও সত্যি, আমি তার জীবনের একটা অংশে পরিণত হয়েছিলাম, আর তিনি আমার জীবনের।
ডেবোরাহ আর আমি সম্পূর্ন আলাদা দুটা পরিবেশ থেকে এসেছি। আমি প্যাসিফিক নর্থওয়েস্ট এলাকায় শ্বেতাঙ্গ ও অজ্ঞেয়বাদী হিসেবে বড় হয়েছি। আমার শিকড় খুজলে দেখা যাবে আমার অর্ধেক নিউইয়র্কের ইহুদী, আর বাকি অর্ধেক মধ্যপ্রাচ্যের প্রোটেস্ট্যান্ট। ডেবোরাহ দক্ষিনে বড় হওয়া একজন কৃষ্ণাঙ্গ, ঘোরতর গোঁড়া একজন খ্রিস্টান। কোনো ঘরে ধর্ম নিয়ে আলোচনা শুরু হলে আমি সে ঘর থেকে চুপটিসারে বের হয়ে যেতাম। যেখানে ডেবোরাহ এর পরিবার ছিল সম্পূর্ন উল্টো। ধর্মপ্রচার এর পাশাপাশি ফেইথ হিলিং, এমনকি ভুডুর ব্যাপারেও তারা আগ্রহী ছিল। দেশের সবচেয়ে বিপদজনক ও গরিব কৃষ্ণাঙ্গদের এলাকায় সে বড় হয়েছে, যেখানে আমি বড় হয়েছি একটা নিরাপদ, মধ্যবিত্ত্ব একটা শ্বেতাঙ্গ পাড়ায়। এমনই শ্বেতাঙ্গপ্রধান এলাকা ছিল সেটা যে, গোটা হাইস্কুলে আমার কেবল দুজন কৃষ্ণাঙ্গ সহপাঠী ছিল। আমি ছিলাম মনেপ্রাণে একজন সায়েন্স জার্নালিস্ট। আধভৌতিক সবকিছুকেই আমি ‘বোগাস’ বলে আখ্যা দিতাম। যেখানে ডেবোরাহ বিশ্বাস করত হেনরিয়েটার কোষগুলোর মধ্যেই হেনরিয়েটার আত্মা বেঁচে আছে, আর সেগুলো নিয়ে যারা ঘাটাঘাটি করে তাদের জীবনেও সে প্রভাব ফেলে। সে তালিকায় আমিও ছিলাম।


‘তাহলে তুমি আমাকে শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। তোমার শিক্ষক কীভাবে হেনরিয়েটার পূর্ণ নামটা জানতো, যেখানে সবাই তাকে হেলেন লেইন নামেই চিনত?” ডেবোরাহ প্রায়ই আমাকে এই প্রশ্নটা করত। “আসলে এভাবেই সে তোমার মনোযোগ আকর্ষন করার চেষ্টা করছিলো।”

এভাবে ভাবলে কিন্তু বলা যায় আমার জীবনের সকল ক্ষেত্রেই তার অবদান রয়েছে। আমি যখন বিয়ে করলাম, তখন হয়ত হেনরিয়েটা চেয়েছিল আমি তার ব্যাপারে বই লেখার সময় কেউ আমার খেয়াল রাখুক। যখন আমার ডিভোর্স হল, তখন হয়ত হেনরিয়েটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ব্যাস, অনেক হয়েছে। আমার স্বামী আমার কাজে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যখন একজন সম্পাদক আমাকে উপদেশ দিয়েছিলেন হেনরিয়েটার পরিবারে অংশটুকু কেটে ফেলতে, তার কদিন পরেই তিনি একটা রহস্যময় দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। ডেবোরাহ অবশ্য সেটারও ব্যাখ্যা নিয়ে প্রস্তুত ছিল। তার মতে, কেউ হেনরিয়েটাকে রাগিয়ে দিলে সে এভাবেই প্রতিশোধ নেয়।


ল্যাকস পরিবার আমার চিন্তাধারনা সম্পূর্ন পাল্টে দিয়েছিল। বিশ্বাস, বিজ্ঞান, জার্নালিজম আর বর্ণ—সম্পর্কে যা যা জানতাম, সবকিছু পাল্টে গিয়েছিল তাদের কারনে। হ্যাঁ, আমি জানি এই বইটা শুধু হেনরিয়েটা আর ‘হেলা কোষ’ নিয়ে নয়। বইটা গোটা ল্যাকস পরিবার, বিশেষ করে ডেবোরাহ কে নিয়ে, যার ‘হেলা কোষ’ ব্যবহারের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়েছে, আর যে বিজ্ঞান এতকিছু সম্ভব করেছে—মোটামুটি এতকিছুর ফসল হচ্ছে এই বইটা।            
       
      
     








1 comment:

  1. এইটুকু করতেই আমার তিনদিন লেগে গিয়েছে। আলসেমিও ছিল খানিকটা

    ReplyDelete

আরো যা দেখতে পারেন