১৯৬৯-১৯৭৩
ভীনদেশের গল্প শুনতে একসময় আমি বেশ পাগল ছিলাম। অনেক আবেগী ছিলাম তখন।
একটা সময়, কাঁটায় কাঁটায় দশ বছর
আগে, আমি যাকে সামনে পেতাম, তার গায়ে চুম্বকের
মত লেগে যেতাম তার জন্মস্থান সম্পর্কে জানার জন্য। সে সময়ে কারো দুঃখ কষ্টের গল্প শোনার মত শ্রোতা কেউ ছিল না, তাই লোকজন আমার সামনে তাদের গল্পের ঝাঁপি খোলা
শুরু করল। জন্মস্থান বাদেও আরো
অনেক কিছু এসে যেত গল্পগুলোতে। যেসব মানুষকে আমি চিনতামও
না, তারাও কোনোভাবে আমাকে খুঁজে বের করল। শুধুমাত্র শ্রোতা বানানোর জন্য তারা এত কষ্ট করতে রাজি ছিল।
তারা যেন শুকনো এক কুয়ো তে ঢিল ছুড়ছে। আমাকে নানান ধরনের গল্প শোনানোর পর তারা বেশ সুখি মনেই বাড়ির
পথ ধরত। কেউ কেউ মন ভরে,তৃপ্তিসহকারে কথা বলত। কেউ কেউ আবার হঠাৎ করে ক্ষেপে যেত মনের ভেতর থেকে কষ্টের গল্পটা
বের করতে গিয়ে। কেউ কেউ খুব সুন্দর
করে গুছিয়ে গল্প বলত। আবার এমন লোকও ছিল, পুরো গল্প শোনার পরও বুঝতে পারিনি গল্পের শুরু
কোথায়, আর শেষ কোথায়। কিছু ছিল বিরক্তিকর গল্প, কিছু তুচ্ছ কষ্টের গল্প, কিছু অর্থহীন বোগাস
গল্পও ছিল। তা সত্বেও আমি সবসময়ই
আদর্শ শ্রোতার মত সব শুনতাম।
প্রত্যেকের মনের ভেতর একটা গল্প লুকোনো থাকে, যা সে কাউকে কিংবা গোটা পৃথিবীকে চিৎকার করে জানাতে চায়। কেন? কে জানে!
প্রত্যেকবার গল্প শোনার সময় আমার মনে হত, আমাকে তারা এক কার্ডবোর্ডের বক্স ঠেসে একদল বানর উপহার দিচ্ছে। আমি একটা একটা করে বানরকে বের করতাম, সাবধানে সেটা পরিষ্কার করতাম, পশ্চাৎদেশে একটা মৃদু চাপড় দিয়ে সেটাকে জঙ্গলে পাঠিয়ে দিতাম। তারা কই
হারিয়ে যেত, তা আমার জানা ছিল না। হয়ত তারা সারাজীবন কোথাও একর্ন ফল খেয়ে সময় পার
করছে। তবে সেটাই ছিল তাদের ভাগ্যে। দূরে কোথাও হারিয়ে যাওয়াই ছিল তাদের পরিণতি।
সেটাই ভাবছিলাম। এত পরিশ্রমের ফলাফল ছিল প্রায় শূন্য। চিন্তা করে দেখলাম, সে
বছর যদি কোথাও ‘সবচেয়ে আন্তরিক শ্রোতা’ বলে প্রতিযোগিতা হত, বাজি ধরে বলতে পারি
আমি প্রথম পুরষ্কার পেতাম। পুরষ্কার হিসেবে হয়ত একবাক্স দেয়াশলাই এর বক্স পেতাম।
যারা গল্প করতে আসতো, তাদের মধ্যে একজন বলেছিল সে নাকি শনি গ্রহ থেকে এসেছে;
আরেকজন দাবি করত সে নাকি শুক্র গ্রহের বাসিন্দা ছিল। তাদের গল্পগুলো আমার বেশ মনে
ধরেছিল। প্রথমে শনি গ্রহের বাসিন্দার গল্প দিয়েই শুরু করি।
“ পৃথিবীর বাইরে....প্রচন্ড ঠান্ডা। ” সে ঘোত করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল। “ সেটার
কথা ভাবলেই আমার ঠা-ঠান্ডা লাগা শুরু করে। ”
সে একটা রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত ছিল। তারা ভার্সিটির ৯ নাম্বার বিল্ডিংটা
দখল করে নিয়েছিল। তাদের আদর্শবাণী ছিল ‘ কাজ থেকেই আদর্শ নির্ধারিত নয়, তার উলটো
টা নয়! ’ তাহলে কাজ কি থেকে নির্ধারিত হয়? অবশ্য তাদের এ প্রশ্নটা করার সাহস কারো
হয়নি। যাই হোক, বিল্ডিং এ এ একটা ওয়াটার কুলার, একটা টেলিফোন, বয়লার সুবিধা ছিল।
এমনকি ওপরের তলায় একটা মিউজিক লাউঞ্জও ছিল, এলটেক এ-৫ স্পিকার থেকে শুরু করে ২
হাজারের বেশি রেকর্ড ছিল। জায়গাটাকে স্বর্গই বলা চলে ( অবশ্যই ৮ নাম্বার বিল্ডিং
এর সাথে তুলনা করলে আরকি। সেটা থেকে রেসট্র্যাকের টয়লেটের মত বিকট দুর্গন্ধ বের
হয়)। প্রতিদিন তারা নিজেদের
ইচ্ছেমত গরম পানি ব্যবহার করে শেভ করত, বিকেলবেলায় যত মন চায়, লং ডিস্ট্যান্স কল
করত। আর রাত নামতেই সকলে একসাথে ঘিরে বসে রেকর্ড শুনত। শরৎকাল শেষ হতে না হতেই
প্রত্যেক সদস্য ক্লাসিকাল গানের পাঁড় ভক্তে পরিণত হয়েছিল।
এরকমই নভেম্বর মাসের এক সুন্দর বিকেলবেলায় একদল পুলিশ জোর করে বিল্ডিং ৯ এ
ঢুকে পড়েছিল। ভেতরে তখন পুরোদমে ভিভালডি এর ‘এল’এস্ট্রো আরমানিকো’ সর্বোচ্চ শব্দে
বাজছিল। আমি জানিনা এর কতটুকু সত্যি, তবে ১৯৬৯ সালের সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী গল্প
হিসেবে সেটি আমার মনে একটা বিশেষ স্থান দখল করে রেখেছিল।
যখন তাদের তথাকথিত স্তুপ করে সাজিয়ে রাখা বেঞ্চের ‘ব্যারিকেড’ পাশ কাটিয়ে
সেখানে পৌছালাম, সেখানে তখন মৃদু সুরে জি মাইনরে হেইডেনের পিয়ানো
সোনাটা বেজেই যাচ্ছিল। আপন বাসার মত পরিবেশ
ছিল সেটি। জায়গাটা বান্ধবীর
বাড়ি যাওয়ার সময় ঝোপেঝাড়ে ফুটে থাকা সানসানকোয়া ফুলের পথের মতই আমন্ত্রন জানাচ্ছিল
আমাকে।
শনিগ্রহ থেকে এসেছে দাবী করা মানুষটা আমার বসার জন্য সেখানকার সেরা চেয়ারটা বের
করে দিল। বিজ্ঞান ভবন থেকে চুরি
করে আনা বিকারগুলোর একটিতে অল্প উষ্ণ বিয়ার ঢেলে আমার দিকে এগিয়ে দিল।
“একই সাথে শনিগ্রহের অভিক্ররষের টান প্রচন্ড বেশি।” শনিগ্রহের
ব্যাপারে সে বকবক চালিয়ে যেতে থাকল। “মুখ থেকে চুইংগাম থু দিয়ে ফেলতে গিয়েই অনেকের
পা ভেঙ্গে গিয়েছে। সত্যিকারের নরক বোধহয়
ওটাই।”
“হুম, শুনে আমারো তাই মনে হচ্ছে। ” কিছুক্ষন
পর মুখস্ত বুলির মত কথাগুলো বললাম। এতদিনে আমি এরকম বকবকানির ফাঁকে ফাঁকে কি বলতে হয়, তা শিখে গিয়েছি। আমার শব্দভান্ডারে এরকম সময়ে ব্যবহার করার মত প্রায় তিনশ’র বেশি শব্দগুচ্ছ তৈরি করা আছে।
“ওখান থেকে সূর্যকেও ছোট মনে হয়। আমি ঠিক করেছি, পাশ করে বের হলেই আমি শনি গ্রহে ফিরে যাব। সেখানে আমি বি-বিশাল এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলব। বি-বিপ্লব করে
ফেলব সেখানে!”
যাই হোক, দূরদূরান্তের গল্প শুনতে
আমার কখনোই খারাপ লাগেনি। শীতনিদ্রায় যাওয়ার আগে ভালুক
যেভাবে খাবার সঞ্চয় করে রাখে, সেরকম ভাবেই আমি অনেক গল্প জমিয়ে রাখছিলাম। মাঝেমধ্যেই
চোখ বন্ধ করলেই কল্পনায় সেসব জায়গার রাস্তাঘাট, সারি সারি বাড়ি দাঁড়িয়ে যেত। আমি সেখানকার
মানুষদের গলার স্বর শুনতে পেতাম, তাদের ধীর-স্থির জীবনের গতি অনুভব করতে পারতাম। অথচ
এত দুরের মানুষ তারা যে, আমি হয়ত কখনোই তাদের সাথে দেখা পর্যন্ত করতে পারব না।
No comments:
Post a Comment