৯.
সকাল পর্যন্ত কিয়োমির অবস্থা আগের মতই থাকলো।
দুপুর হওয়া শুরু হতেই তার ব্লাড প্রেশার দ্রুত গতিতে কমে যেতে শুরু করলো। একটা বাজে সেটা নামতে নামতে ৯৫ তে
পৌঁছে গিয়েছিলো।
আর একঘন্টা পরে সেটা ৮০তে গিয়ে দাঁড়ালো। আইসিইউ তে ডাক্তাররা ভিড় করা শুরু করলো।
নার্সদের ছোটাছুটিতে গোটা আইসিইউ সরগরম হয়ে উঠল। তারা তোশিয়াকি আর তার শ্বশুরকে সেখান থেকে বের করে দিলেন।
ব্রেন ডেথের পরীক্ষা হবে এখন।
“সিসিএইচ(CCH) ট্রান্সপ্ল্যান্ট টিম আড়াইটার মধ্যেই এখানে এসে পৌঁছাবে।” ডাক্তারদের একজন ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে তাদের জানালেন। “ক্যাথেটার প্রবেশ করানোর মাধ্যমে তারা তাদের কাজ শুরু করবেন। তারপর পালস বন্ধ হয়ে গেলেই কিডনি বের করার কাজ শুরু হবে।”
“সে সময়টাতে আমরা কি তার পাশে উপস্থিত থাকতে পারবো?”
ডাক্তারটা সম্মতির সুরে মাথা নাড়লেন।
“আপনাদের পাঁচ মিনিট দেয়া হবে তাকে বিদায় জানানোর জন্য। তারপরেই তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে আসা হবে।”
কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস যন্ত্রটা তখন সাপের মত ফোঁস ফোঁস শব্দ করা শুরু করেছিলো। কিয়োমির ব্লাড প্রেশার তখন ৭৫ এ নেমে গিয়েছে।
ইয়োশিজুমি,
সাথে ওদাগিরি ও আরো দুজন স্টাফ মেম্বার ইউনির্ভাসিটি হাসপাতালে প্রবেশ করলেন। তাদের সাথে তেমন জিনিসপত্র ছিল না। তবে কয়েকটা সার্জিকেল যন্ত্রপাতি ছিল, যা কিনা অপারেশনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। আর হ্যাঁ, সাথে কিডনি সংরক্ষনের জন্য পারফিউশান কন্টেইনারও এনেছিলেন তারা।
ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল হওয়ার কারনে হয়ত এখানে অনেক কিছুই সহজে পাওয়া যাবে।
কিন্তু ইয়োশিজুমি সবসময় কিডনি উত্তোলনের ক্ষেত্রে সব প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি হাতের কাছে রাখতেন। এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। আর এরকম অপারেশনের ক্ষেত্রে সময় জিনিসটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় নিজের পরিচিত যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করাই যুক্তিযুক্ত।
হাসপাতালের স্টাফের
সাথে অভিবাদন ও অন্যান্য কাজ সেরে নেবার পর
ইয়োশিজুমি ওদাগিরিকে ওয়েটিং রুমে রেখে তৎক্ষনাৎ ডোনারের অবস্থা দেখার জন্য আইসিইউ’তে চলে গেলেন। ডোনারের ব্লাডপ্রেশার
তখন ৬৫
এর আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। হার্ট প্রতি মিনিটে কেবল ৩০বার স্পন্দন করছিলো।
ব্লাড প্রেশার ৫০ এর নিচে নামলেই রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে, ফলে কোষ ধ্বংস হওয়া শুরু হবে। যেহেতু ডোনারের পরিবার কাজটা করার অনুমতি দিয়ে দিয়েছে, সেহেতু এখন তার ফিমোরাল ধমনীতে ক্যাথেটার প্রবেশ করানো হবে। তাহলে প্রেশার ৫০ এর
নিচে নামলেই কাজ করা শুরু করতে পারবে তারা।
ওখানকার হেড ডাক্তার ইয়োশিজুমির কাছে ডোনারের সকল তথ্য সম্বলিত চার্টটা বাড়িয়ে দিলেন। ওদাগিরিকে তখন ইন্টারকমের মাধ্যমে জানানো হল যে, এখন ক্যাথেটার প্রবেশ করানো হচ্ছে।
পনের মিনিট পর ইয়োশিজুমি আর তার সহকারী
ডাক্তাররা পারফিউশান যন্ত্রটা প্রস্তুত করলেন।
ডোনারের পা
দুটো দুদিকে সামান্যস সরিয়ে পায়ের মাঝের জায়গাটাতে যন্ত্রটা রাখলেন। সহযোগীদের একজন যন্ত্রটার সেটিংস ঠিকঠাক করতে শুরু করলেন।
আরেকজন ডোনারের পায়ের যে জায়গায় ক্যাথেটার প্রবেশ করানো হবে, সেটা জীবাণুমুক্ত
করতে লাগলেন।
একটা সিলিকনের ক্যাথেটারকে প্রস্তুত করা হলো। জীবাণুমুক্ত করার পর ইয়োশিজুমি ডোনারের বাম পাশে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকালেন।
ফিমোরাল ধমনী আর শিরা সব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল কিনা, তা আবার দেখে নিলেন। আড়চোখে যখন দেখলেন যে, তার সহযোগীরা প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে,
তিনি ক্যাথেটারটা ডোনারের
ভেতর প্রবেশ করিয়ে দিলেন।
খুবই সতর্কতার সাথে তিনি ক্যাথেটারটা প্রবেশ করাতে লাগলেন। জায়গামত পৌঁছানোর
পর তিনি থেমে গেলেন। আলতো ভাবে মাথা নেড়ে তিনি তার সহযোগীদের বলে দিলেন আর
কী কী
করতে হবে।
তারা ক্যাথেটারের শেষপ্রান্তে
একটা পারফিউশান পাম্প জুড়ে দিল।
তারপর তিনি আবার ক্যাথেটারটা আস্তে আস্তে ফিমোরাল ধমনীতে প্রবেশ করিয়ে সেটার সাথেও সংযোগ স্থাপন করে দিলেন। প্রস্তুতিমূলক কাজের সমাপ্তি ঘটেছে।
ডোনারের ব্লাড প্রেশার এখন ৬২
এর ঘরে ঘোরাফেরা করছে, হার্টের
স্পন্দনও অনেক কমে গিয়েছে।
ইয়োশিজুমি আর তার সহযোগীরা
মিলে কিছু সময়ের জন্য আইসিইউ থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ডোনারের পরিবারকে দেখতে পেরে তিনি তাদের ইঙ্গিত করলেন ভেতরে যাওয়ার জন্য।
তিনি নিজে ডাক্তারের অফিসে যেতে শুরু করলেন। তার সাথে ডোনারের পরিবারের কোনো প্রকার সাক্ষাৎ হয়নি। তার বিশ্বাস, ডোনারের পরিবারের থেকে যতটা দূরে থাকা যায়, ততটাই তার জন্য মঙ্গল। শোকাগ্রস্থ কোনো পরিবারের কাছে একজন ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জনকে হায়েনা বলেই মনে হবে।
তারা তো
হায়েনার মতই তাদের প্রিয়জনের কাছ থেকে একটা অঙ্গ ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে।
অবশ্য ইয়োশিজুমি মূল অপারেশনের পূর্বে রোগীর পরিবারের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। যদিও পরিবারের
সাথে বন্ধন তৈরি করা তার কাজ নয়। বরং সেটা ট্রান্সপ্ল্যান্ট কো-অর্ডিনেটর এর
কাজ। তবে এভাবে তাদের এড়িয়ে গেলেও ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। ইয়োশিজুমি অফিসের সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে একটু পরপর মগে চুমুক দিয়ে গরম কফি খেতে থাকলেন।
মারিকো আনজাই এর চেহার তার চোখের সামনে ভেসে উঠল।
‘সে’ পরিবর্তনটা টের পেতে শুরু করেছে।
কিয়োমি নাগাশিমার দেহ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
দুর্ঘটনার পর
তার শরীরে একটা পরিবর্তন হচ্ছিল।
ধীরে ধীরে,
কিন্তু হচ্ছিল ঠিকই। এখন হঠাৎ করে সেটার গতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছে। কিয়োমি মারা যেতে শুরু করেছে : তার শরীরের
উষ্ণতা কমে যাচ্ছে। একসময় সেটা শক্ত হয়ে যাবে, পরে সেটা ভেঙ্গে যেতে শুরু করবে। তার মস্তিষ্ক ইতোমধ্যে ক্ষয়ে যাওয়া শুরু করেছে।
হরমোনের ডিসচার্জও খুব শীঘ্রই বন্ধ হয়ে যাবে। রক্তের প্রবাহের গতি অনেকখানি কমে গিয়েছে। কোষগুলো ভেঙ্গে সেগুলোর ভেতরের সবকিছু বেরিয়ে আসা শুরু করেছে।
সবকিছুই পরিকল্পনা মোতাবেক আগাচ্ছে।
কিয়োমির দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেয়া সবচেয়ে সোজা কাজ ছিল। তার অপটিক্যাল
নার্ভে সামান্য ট্রিক খাটালেই সেটা করা সম্ভব। ঐ
মুহূর্তে ‘সে’ কিয়োমির
দেহের প্রবাহটা অন্যদিকে টেনে নেয়া শুরু করলো। দুর্ঘটনায় যাতে কিয়োমির শরীরের খুব একটা ক্ষতিসাধন না হয়, সেটা ‘তার’ প্রধান চিন্তা ছিল। ব্রেন ডেথই হতে হবে তার। যদি মাথার বদলে কিয়োমি পেটে আঘাত পেত,
তবে পেটের ভেতরের অন্য কোনো অঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হত। আর তখন কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের আশা ছেড়ে দিতে হত। দুর্ঘটনার সময়
‘সে’ খুবই নিখুঁতভাবে সময়ের ব্যবহার করে ব্রেক ব্যবহার কষেছিল। ‘সে’ কিয়োমির পেটটা শক্ত করে ধরে রেখেছিল, যাতে সেটা সামনের দিকে ছিটকে চলে না
যায়। স্টিয়ারিং হুইলে রাখা হাতদুটোকে
‘সে’ এমনভাবে
ব্যবহার করেছিলো যাতে তার পেরিফেরাল ইঞ্জুরি না হয়। কিয়োমির কপাল স্টিয়ারিং হুইলে সর্বশক্তিতে আঘাত করেছিলো। ‘সে’ টের পেয়েছিল,
আঘাতের ফলে খুলি ভেঙ্গে সেটার টুকরোগুলো মস্তিষ্ককে বিদীর্ণ করে দিয়েছিল। প্রত্যেকবার সেই মুহূর্তের কথা মনে পড়লেই ‘তার’ শরীরটা শিউরে ওঠে। কিয়োমির মৃত্যু
হবে, কিন্তু ‘সে’ অনন্তকাল
বেঁচে থাকবে।
অনন্তকাল।
কিয়োমির কিডনি দুটো দুজন রোগীর দেহে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হবে। এদের একজন মহিলা হলেই গোটা প্রক্রিয়াটার সুন্দরভাবে সমাপ্তি
ঘটবে। তোশিয়াকি
‘তার’ পরিকল্পনা
মোতাবেক প্রাইমারী কালচার বানাবে। তোশিয়াকি জানেও না যে,
‘সে’ অনেক আগেই এসব চিন্তা করতে তাকে প্রভাবিত করেছে।
তোশিয়াকি।
‘সে’ তার অবয়বটা কল্পনা করতেই ‘তার’ গোটা শরীর শিউরে উঠল। সময় হয়ে এসেছে। ‘তার’ গোটা অস্তিত্বটাই অস্থির
হয়ে উঠেছে।
তোশিয়াকির গলার স্বর ‘তার’ মনে পড়লো। তার অনুভূতি, তার শরীরের
উষ্ণতা- সব। এরকম একটা মানুষের জন্যই ‘সে’ এতদিন ধরে অপেক্ষা করছিলো। সে-ই একমাত্র মানুষ যে কিনা
‘তাকে’ বুঝতে পারবে, ‘তার’ সত্যিকারের অস্তিত্বটা উপলব্ধি
করতে পারবে।
এরকম একটা অপূর্ব সুযোগ ‘সে’ ছেড়ে দেবে না।
‘সে’ তার সাথে মিশে এক হয়ে যাবে।
অধিক উত্তেজনায় ‘তার’ খিঁচুনি
হওয়া শুরু করলো। কিয়োমির ব্লাড প্রেশার অস্বাভাবিক গতিতে কমা শুরু হতেই ‘সে’ নিজের পরম সুখের কাছে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে দিল।
ইয়োশিজুমি আর তার সহকারীরা
যখন জানতে পারলো যে ডোনারের ব্লাড প্রেশার ৫০
এঁর নিচে নেমে গিয়েছে, সকলেই আইসিইউ’তে ফিরে আসলো।
ক্যাথেটার ঢোকানোর পর প্রায় একঘন্টা
কেটে গিয়েছে।
সহযোগিরা অনেকগুলো রিংগার সলুশন বোতল*
প্রস্তুত করে রেখেছে, যার সাথে পেরিস্টা পাম্প সংযুক্ত ছিল। ক্যাথেটার ঠিকঠাক আছে কিনা,
পরীক্ষা করার পর ইয়োশিজুমি এঁর সাথে সংযুক্ত বেলুন দুটো ফুলিয়ে ভেতরে বিশুদ্ধ বায়ু প্রবেশ করালেন। ফলে ভেতরের
রক্তপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি হবে।
ইয়োশিজুমি সংকেত দেয়া মাত্রই তার সহযোগীরা পাম্প চালু করে দিল।
ঠান্ডা পারফিউসেট*
ক্যাথেটারের ভেতর দিয়ে খুবই হিসাব করা গতিতে প্রবাহিত হতে লাগলো। ইয়োশিজুমি ডোনারের বুকে হাত রেখে যাচাই করতে লাগলেন আদৌ সেটা ভালভাবে পরিবাহিত হচ্ছে কিনা।
মনুষ্যদেহে একটা প্রধান অ্যাবডোমিনাল ধমনী আর শিরা আছে, যার মধ্য দিয়ে প্রচুর পরিমানে রক্ত প্রবাহিত হয়। যে
ধমনীগুলো কিডনিতে রক্ত প্রবাহিত করে সেগুলো এখানের সাথে সংযুক্ত থাকে। একই কথা শিরাগুলোর ক্ষেত্রেও সত্য। উদরের নিচের অংশে সেই শিরা আর ধমনী বেরিয়ে দুই পায়ের দিকে চলে যায়।
শীর্ষে বেলুন লাগানো ক্যাথেটার ওরকমই একটা ধমনীর শাখার ভেতর ঢোকানো হয়েছে।
আর এর
মাধ্যমে পারফিউসেট
(এক ধরনের শীতল তরল পদার্থ)
ভেতরে প্রবেশ করে যাতে সোজা অ্যাবডোমিনাল ধমনীতে চলে যেতে পারে, সেজন্য
বেলুনের মধ্যখানের টিউবে ফুটো করা ছিল। যেহেতু বেলুনগুলো
ধমনীর মধ্য দিয়ে রক্ত প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে,
সেহেতু পারফিউসেট সোজা কিডনীতে চলে যেতে সক্ষম হচ্ছে।
ডোনারের কিডনি খুব দ্রুত শীতল হয়ে যাচ্ছে। পারফিউসেট প্রবাহিত হয়ে যাবার পর সেটা কিডনীর
শিরায় চলে যাবে। সেখান থেকে উদরের নিচের অ্যাবডোমিনাল শিরায় পৌঁছে যাবে। আর সেখান থেকেই সেটা পুনরায় পারফিউশান যন্ত্রে ফিরে আসবে।
যতটা তাজা কিডনি পাওয়া সম্ভব, ততই ভাল। ব্রেন ডেড ডোনারদের কাছ থেকে নেয়া কিডনির সাথে হার্ট ফেইলিয়র হওয়া ডোনারের কিডনির তুলনা করলে দেখা যাবে,
রক্ত স্বল্পতার কারনে হার্টের রোগির কিডনি গ্রহণযোগ্যতা কম। এরকম ক্ষতির হাত থেকে কিডনিকে বাঁচানোর জন্যই হার্ট ফেইলিয়রের সাথে সাথে পারফিউসেট প্রবেশ করিয়ে কিডনিকে ঠান্ডা করানো একটা সাধারন নিয়মে পরিণত হয়েছে। কিডনি উত্তোলনের আগে সেটাকে ঠান্ডা করে নিলে সেগুলো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার পর কিডনী গ্রহীতার
দেহে সেটা সঠিকভাবে কাজ করার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। ডোনারের পরিবারের
মত থাকলে হার্ট ফেইলিয়েরে আগে থেকেই প্রক্রিয়াটা শুরু করা যায়।
সহযোগীদের একজন নির্দিষ্ট সময় পর পর পারফিউশানের
গতি রিপোর্ট করতে লাগলো। অপরজন ডোনারের হার্টের গতি মনিটর করতে লাগলো।
ডোনারের ত্বক ইতোমধ্যে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারনে ঠান্ডা ও ফ্যাকাশে হওয়া শুরু করেছে।
পারফিউশান শুরু হবার পর প্রায় চল্লিশমিনিট পার হয়েছে।
তার হার্ট একটু পর পর
কেঁপে উঠছে,
ফলে পালসের গতিও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে।
“ডোনারের পরিবারকে ডাকুন।” ইয়োশিজুমি ডোনারের ডাক্তার আর নার্সের দিকে তাকিয়ে নির্দেশ দিলেন। “এখনই তারা শেষবারের মত
ওকে জীবিত দেখতে পারবেন।”
পাঁচটা বিশমিনিটে একজন নার্স ওয়েটিং রুমে এসে তোশিয়াকি আর কিয়োমির পরিবারের সামনে এসে পরিস্থিতি সংক্ষেপে জানালেন।
তারপর তাদের সাথে করে আইসিইউ’তে ফিরে গেলেন।
ঘরে ঢোকার সাথে সাথে তোশিয়াকি কিয়োমির অস্বাভাবিক পরিবর্তন
দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। কাঁদতে না পেরে স্থিরভাবে
পাথরের মত
মুখ করে তিনি কিয়োমির ডাক্তারকে অনুসরণ করলেন। যতই তিনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন,
ততই কিয়োমির মুখটা তার কাছে অস্পষ্ট মনে হচ্ছিলো।
আশেপাশে তাকিয়ে শেষমেষ তিনি স্ট্রেচারের বামপাশে
গিয়ে দাঁড়ালেন।
তার পিছনে দাঁড়িয়ে থেকে তার শ্বাশুরি কাঁদতে শুরু করেছিলেন।
“কিয়োমির শরীরের সকল তথ্যাদি এখানে দেয়া আছে, কিন্তু
এখন তার পালসের গতি অনিয়মিত হয়ে গিয়েছে বলে সেটা প্রমাণ করা শক্ত হবে।” কিয়োমির
স্ট্রেচারের পাশে থাকা মনিটর দেখিয়ে ডাক্তার ব্যাখ্যা করলেন। “কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস এখনো চলছে, কিন্তু
তার হার্টবিট একদম নেই বললেই চলে। ব্লাড প্রেশারও
অনেক কমে গিয়েছে। তার ত্বকের
দিকে তাকালেই সেটা টের পাবেন।”
কিয়োমির মুখটা এতটাই ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল যে, সেটা একদম স্বচ্ছ বরফের মত
মনে হচ্ছিলো।
তার ঠোঁটদুটো দেখে মনে হচ্ছিল,
সাদা বরফের মত ত্বকের মাঝে দুটো ফুলের পাপড়ি বেরিয়ে আছে।
ভেতরে রক্তের প্রবাহ পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। কোনকিছু চিন্তা না করেই তোশিয়াকি তার গালের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আঙ্গুলের সাথে স্পর্শ হতেই তার মনে হল সেখান থেকে তার মাথার পেছনে একটা ভোঁতা অনুভূতি পৌঁছে গিয়েছে।
একবার তিনি ভুলবশত ড্রাই আইসে হাত দিয়েছিলেন, অনেকটা
সেরকম লাগলো তার কাছে। বুকের ভেতর ব্যথার একটা অনুভূতি তিনি টের পেলেন। তার হাত কাঁপতে শুরু করলো। তিনি তার তর্জনী আর
মধ্যাঙ্গুলি দিয়ে তার গালটাকে স্পর্শ করতে থাকলেন। আস্তে আস্তে হাতটা নামিয়ে বুকের যেখানে রক্তের শিরাগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো, সেখানে থেমে গেলেন। পরে থাকা কাপড়ে ঢেকে থাকা সত্ত্বেও তিনি দেখতে পেলেন, কিয়োমির
নিপল দুটো খাড়া হয়ে আছে।
তোশিয়াকি নিজের হাতটা উঠিয়ে নিয়ে উষ্ণতার জন্য সেটা অপর হাত দিয়ে ধরে রাখলেন।
ঠান্ডা একটা আভা সে হাত থেকে বের হচ্ছিল।
থপ।
তার হার্ট আচমকা স্বভাবিক গতি থেকে একদম সশব্দে বুকের ভেতর লাফিয়ে উঠল। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল কেন জানি। নিজেকে সামলানোর
জন্য সে
হাত দিয়ে নিজের বুকটা চেপে ধরলো। তাকে যেন বিভ্রান্তিতে ফেলানোর জন্য সেটা আবার বুকের খাঁচার ভেতর লাফিয়ে উঠলো। আবার তার শরীর আগের মত উত্তপ্ত লাগছে।
“যদি আপনারা অনুমতি দেন, তবে আমরা এখন কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস যন্ত্রটা বন্ধ করে দেব।” ডাক্তার তাদের জানালেন।
হাত দিয়ে বুকটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তোশিয়াকি কিয়োমির দিকে কয়েকমুহূর্ত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর জোরে একটা শ্বাস টেনে নিলেন। তার অস্থির হয়ে থাকা ফুসফুস বাতাসের কারনে আগের চেয়ে বেশি ফুলে গেল। কিয়োমির
দেহটা এখন ধ্বংস হয়ে যাবে,
তিনি ভাবলেন।
ডাক্তার তখন যন্ত্রটা সুইচ টিপে বন্ধ করে দিলেন।
যে যন্ত্রটা এতক্ষন নিয়মিত স্পন্দনে শব্দ করছিলো, সেটা একটানা হিসস শব্দ করা শুরু করলো। কিয়োমির বুকের নড়াচড়া অবশেষে থেমে গেল। ডাক্তার নিজের ঘড়ি দেখে ঘোষনা করলেন : “মৃত্যুর
সময় পাঁচটা একত্রিশ মিনিট।”
কিয়োমির বাবা শব্দ করে একটা শ্বাস টেনে নিলেন।
থপ।
তোশিয়াকির হৃৎপিন্ড আবার জোরে লাফিয়ে উঠে কাঁদার চেষ্টা করলো। তার হৃৎপিন্ড
এত জোরে শব্দ করছে, অথচ কেউ টের পাচ্ছেনা কেন? হয়ত কিয়োমি তার সর্বশেষ জীবনীশক্তিটুকু তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তাহলে কি ওটা কিয়োমির
সর্বশেষ হৃৎস্পন্দন ছিল? সে যেন তোশিয়াকিকে এভাবে বলার চেষ্টা করছে : আমি মরে যেতে চাইনা, বাঁচতে
চাই।
“কিডনি উত্তোলনের পর তাকে পোস্টমর্টেম এর জন্য মর্গে স্থানান্তরিত করা হবে।” ডাক্তার তাদেরকে জানালেন। এরপর নম্রভাবে তাদেরকে এখান থেকে চলে যেতে বললেন।
তোশিয়াকি আর তার শ্বশুর-শ্বাশুরী আইসিইউ থেকে বের হয়ে আসলেন।
হলওয়েতে তিনজন ডাক্তার দাঁড়িয়ে ছিল, পেছনে ওদাগিরি একটা বড়সড় বাক্স হাতে তাদের নির্দেশনা
দিচ্ছিলেন। ঐ তিনজনদের একজন তাদেরকে দেখতে পেয়ে তাদের দিকে এগিয়ে এলেন। দেখে মনে হচ্ছে
তার বয়স চল্লিশের ঘরে, কিন্তু তার চোখেমুখে একটা চাপা গৌরববোধ কাজ করছিলো। তাদের সামনে
দাঁড়িয়ে মাথা নুইয়ে তাদের সম্মান জানালেন।
“আমি তাকাশি ইয়োশিজুমি। সেন্ট্রাল হাসপাতাল এর ট্রান্সপ্ল্যান্ট
কমিটির একজন স্টাফ। আমাকে কিডনি দুটো উত্তোলনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আমরা এক্ষুনি অপারেশনটা
শুরু করতে যাচ্ছি। এভাবে চাঁছাছোলা কথা বলার জন্য প্লিজ মাফ করবেন।”
“সমস্যা নেই। শুভকামনা রইল।”
তোশিয়াকি তার দিকে হাতটা বাড়িয়ে ইয়োশিজুমি নামের এই ভদ্রলোকের
সাথে করমর্দন করলেন। ইয়োশিজুমি অবশ্য অবাক একটা চেহারা নিয়ে তোশিয়াকির মুখটা খুঁটিয়ে
খুঁটিয়ে দেখছে।
“কিছু বলবেন কি?”
“না। কিছু না।”
ইয়োশিজুমি আবার মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে সরে গেলেন। তাকে দেখে
মনে হল সে তাদের আড়ালে চলে যেতে চাইছে। বাকি দুজন ডাক্তার আর কো-অর্ডীনেটরের সাথে প্রস্তুতি
রুমে চলে গেলেন।
কিছুক্ষন পর কিয়োমির স্ট্রেচারটা অপারেশন থিয়েটারে ঠেলে নিয়ে
যাওয়া হল।
“আপনারা ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করুন।” একজন নার্স তাদের অনুরোধ
করলেন।
কিয়োমির বাবা মা দুজনে ওয়েটিং রুমে ঢুকে নিজেদের সামলাতে না
পেরে ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন। ব্যাপারটা দেখতে পেয়ে তোশিয়াকি আর ভেতরে ঢুকলো না। সে
হলওয়েতে একটা ফোন খুঁজতে চলে গেল।
“কিয়োমি…আরেকটু অপেক্ষা করো।” সে বিড়বিড় করে উঠল। তার বারবার
কিয়োমির সেই ফ্যাকাশে চেহারার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। খুব শীঘ্রই সে তাকে একটা উষ্ণ জায়গায়
নিয়ে যাবে। সেখানে সে তার দেখাশোনা করতে পারবে।
কিয়োমি, আমি কখনোই তোমাকে
ফেলে থাকতে পারবোনা।
মারিকোকে তখন একটা স্ট্রেচারে শুইয়ে সেটা ঠেলে অপারেশন থিয়েটারে
নেয়া হচ্ছে। শিগেনরি আনজাই তার অচেতন থাকা মেয়ের হাত ধরে তার সঙ্গ দিচ্ছিলেন।
“দুঃখিত স্যার, কিন্তু আপনি আর সামনে এগোতে পারবেন না।” তারা
অপারেশন থিয়েটারের কাছাকাছি পৌঁছাতেই নার্সদের একজন তার হাতে হাত রেখে তাকে জানালো।
যেসব অল্পবয়স্ক ডাক্তাররা স্ট্রেচারটা ঠেলছিলেন, তারা দরজা খুলে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে
পড়লেন। ভেতরে উঁকিঝুঁকি মারার সুযোগও পেলেন না তিনি।
“বাকিটা আমাদের হাতেই ছেড়ে দিন।” ডাক্তাররা যাওয়ার আগমুহূর্তে
তাকে আশ্বস্ত করার জন্য বললেন।
আনজাই সাহেব নিজের হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটু আগেই
এই হাত দিয়ে তিনি মারিকোকে ধরে ছিলেন। মনের অজান্তেই মারিকোর শরীরের সেই উষ্ণতাটা বাঁচিয়ে
রাখার জন্য হাতটা শক্ত করে মুষ্ঠিবদ্ধ করলেন।
“মিস্টার আনজাই, একটু শান্ত হোন। সবই ঠিকঠাক মত হবে। ওখানে বসে
বিশ্রাম নিন।” একজন নার্স তাকে ওয়েটিং রুমে নিয়ে গেলেন। তাকে একটা সোফায় বসিয়ে একটা
ভেন্ডিং মেশিন থেকে কফি এনে দিলেন। তিনি আনজাই সাহেবের কাছে কাগজের কফি কাপটা বাড়িয়ে
দিতেই তিনি সেটা দু’হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলেন। আগের রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তার মনে পড়ে
যাচ্ছে।
কো-অর্ডীনেটর এঁর সাথে কথাবার্তা শেষে তিনি একটা ট্যাক্সি ভাড়া
করে দুজনে সোজা হাসপাতালে চলে এসেছিলেন। গোটা রাস্তাতেই মারিকো এতটাই চেঁচামেচি করছিলো
যে, আনজাই সাহেব ভয় করছিলেন তার আবার শারীরিক কোনো সমস্যা দেখা না দেয়। হাসপাতালে পৌঁছাতেই
সে কিছুটা শান্ত হয়েছিল। কিন্তু কান্নাকাটি থামায়নি। সে তো আগেরবার এরকম আচরণ করেনি।
মারিকো’কে সাথে সাথে আইসিইউ’তে নিয়ে নানান টেস্ট করানো শুরু
করা হল। তার ডায়ালাইসিসের তথ্য, ব্লাড প্রেশার আর পটাশিয়াম কাউন্ট দেখে তাকে ডায়ালাইসিস
আর ট্রান্সফিউশান করতে পাঠানো হল। কোনো রোগবালাই আছে কিনা, তার জন্যও গাদাখানেক পরীক্ষা
করা হল। তার ডাক্তাররা ধরে নিয়েছিলেন যে, অপারেশনের ভয়ে সে কান্নাকাটি করছে। যখন মারিকোকে
সবকিছু বিস্তারিত ভাবে জানানো হল, তাকে দেখে একটা প্রাণহীন বস্তু মনে হচ্ছিল।
“আপনি অপারেশনের জন্য রাজি তো?” ইয়োশিজুমি জিজ্ঞেস করলেন। আনজাই
স্বাভাবিকভাবেই সম্মতি জানালেন। এবার প্রশ্নটা তিনি মারিকো’কে করলেন। “আর তুমি?”
“ঐ মানুষটা কি সত্যিই মরে গিয়েছে?” সে হতাশার সুরে প্রশ্ন করলো।
ইয়োশিজুমি অবশেষে মারিকোর মনের অবস্থাটা ধরতে পারলেন। তাকে বোঝালেন
যে, ডোনার ইতোমধ্যে ব্রেন ডেড পর্যায়ে চলে গিয়েছে। তার বেঁচে ফেরার আর কোনো সম্ভাবনা
নেই।
টেস্ট শেষে দেখা গেল মারিকোর অপারেশনের জন্য একদম ফিট। সন্ধ্যার
মধ্যেই আজকের অপারশনের জন্য তাকে প্রস্তুত করা হয়েছিল। পেটের কাছে থাকা অবাঞ্ছিত লোম
শেভ করে দেয়া হয়েছিল। সেই সাথে পেট থেকে নিচের দিক পর্যন্ত গোটা অংশটা জীবাণুমুক্ত
একটা চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল। যাতে অপারেশনের সময় রেজর বার্ন থেকে কোনোপ্রকার ইনফেকশান
না হয়। তাকে ইমিউনো সাপ্রেসেন্টও দেয়া হল। আনজাই সারারাত তার বিছানার পাশে বসে তার
দিকে লক্ষ্য রেখেছিলেন।
ওদাগিরি খুবই চালাক একজন মহিলা। তিনি মারিকোর মনটা অস্থির হয়ে
থাকার কারনটা খুব সহজেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই কান্নাকাটির মধ্যে তিনি সারারাত মারিকোর
সাথে উৎসাহমূলক নানান কথা বলে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। আনজাই সাহেবের মনটা
তখনো খচখচ করছিলো। কিন্তু সবাই ধৈর্য নিয়েই পরিস্থিতিটা সামলাচ্ছিলো।
দেড়টার দিকে সংবাদ আসলো, ট্রান্সপ্ল্যান্ট শুরু হতে যাচ্ছে।
ইয়োশিজুমি নিজে এসে সংবাদটা তাকে জানালেন। শোনার পর তার চোখ দুটো অস্থিরতায় আর ভয়ে
এতটাই বড় হয়ে গেল যে, তার মনে হতে লাগলো এক্ষুনি সেগুলো কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। তার
ঠোঁট কাঁপতে শুরু করলো, দাঁত কিড়মিড় করতে লাগলো।
“ভয় পাবেন না। আগের মতই সবকিছু হবে। আমি ওয়াদা করছি, আমি সবদিকে
খেয়াল রাখবো।” ইয়োশিজুমি শান্ত সুরে কথাটা বলে আঞ্জাই সাহেবকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা
করলেন। মারিকোর চুলে হাত দিয়ে তাকে আদর করে দিলেন।
মারিকো একসময় আবার চোখ খুলল। ভয়ার্ত স্বরে সে ঠিক একই প্রশ্ন
করলো, “যে মানুষটার কিডনি আমি নিতে যাচ্ছি, তিনি কি মারা গিয়েছেন? সত্যি সত্যি মারা
গিয়েছেন? তিনি আর ফিরে আসবেন না?”
ইয়োশিজুমি তখন আশেপাশে ছিলেন না। ততক্ষনে তিনি ইউনিভার্সিটি
হাসপাতালে চলে গিয়েছেন। সেখান থেকে মারিকোর জন্য একটা ‘সত্যিকারের’ মৃত মানুষের কাছ
থেকে কিডনি আনতে গিয়েছেন।
আনজাই সাহেব নার্সের মুখের দিকে তাকালেন। নার্সের চোখেমুখে একটা
সহানুভূতির ছাপ ফুটে উঠেছিল। অবচেতন মনে তার পেছনের ঘড়ির দিকে তার চোখ পড়ে গেল। ঘড়িতে
তখন পাঁচটা পয়ত্রিশ বাজে।
No comments:
Post a Comment